একটু সময়

209933941 503381257617642 1284014363277275972 n
Read Time:12 Minute, 0 Second
বিয়ের পর রনিকে রেখে এক রাতও কোথাও থাকিনি।রনি আমার স্বামী। দুজন দুজনকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি আমরা।ওকে ছেড়ে কিছুতেই থাকতে ইচ্ছে করে না।
কোথাও গেলে মনে হয় আমি না থাকলে ও কি খাবে?কিভাবে কি করবে? তাই বাবার বাসায় গেলেও রাত থাকতাম না।চলে আসতাম ওর টানে।অদ্ভুত এক টান ছিল। ওর আমার জন্য এমন টান ছিল কিনা বুঝতাম না।ও বলত কিছু দিন ওখানে থাকো টান বাড়বে।কি আজব কথা।
রনিকে একদিন বলেছিলাম তুমি রাজুকে এমন কর কেন? ও তো তোমারই ছেলে।ওকে কি সত্যি ভালোবাস?
রনি আমাকে অবাক করে উত্তর দিয়েছিল।বলেছিল, মায়ের সাথেই যে সম্পর্ক।তো ছেলের সাথে কেমন সম্পর্ক হবে?
আমি সেদিন মাটিতে ছিলাম না।মনে হল শূন্যে ভাসছি।পায়ের নিচে মাটি নেই। কতটা দূরত্ব চলে এসেছে এই জীবনে।
যতই প্রয়োজন হোক সকালে কোথাও গেলে সন্ধ্যায় বাসায় থাকতাম।বাসায় আমি আর রনি ছাড়া কেউ ছিল না।তাই ওকে একা করে যেতে মন চাইত না।
কিন্তু প্রথম ছেলে হওয়ার পর একা আর পেড়ে উঠছিলাম না।একা একটা বাচ্চা মানুষ করা কম কষ্টের না।ছেলেটা রাতে ঘুমাতো না।ভোরে ঘুমাতো আর দুপুরে উঠত।আমার শরীর মন দুটোই খারাপ হতে থাকল।কিন্তু কিছু করার নেই। মাঝে মাঝে বাবার বাসায় যাই।দুই দিন থেকে চলে আসি।
সময় মতো না খাওয়া, না গোসল। ধীরে ধীরে অস্থিরতা কাজ করতে লাগল মনে। রনি একটু উদাসীন ছিল।কখনো আমার খোঁজ নিত না।আমি খেয়েছি কিনা? কি করছি?ছেলেটা কি করছে? এগুলো তার যেন কোন দায়িত্বে পড়ে না।খুব কষ্ট লাগত।
একা রান্না করা।অন্য সব কাজ করা।খুব ক্লান্ত হয়ে যেতাম।মাঝখানে ছেলেটা একা একা থাকতো।কথা বলার কেউ নেই। আর আমিও কেমন জানি খুব কম কথা বলতাম।মনটা চুপসে থাকত।বাহিরে আগে প্রায়ই যেতাম। ছেলে হওয়ার পর আর তেমন বের হওয়ার হয় না।মাঝে মাঝে দমবন্ধ লাগত।
সময় রনি আমাদের সময় দিত না।অথচ অভিযোগ করত আমি তাকে সময় দেই না।তার খেয়াল রাখি না।বাস্তবতা ছিল ভিন্ন রকম সে আমাদের খেয়াল রাখত না।
কাজের সময় ছেলের হাতে আইপ্যাড দিয়ে তাকে ছড়া দেখতে দিয়ে কাজ করতাম।তার মোবাইল আর টিভির প্রতি আসক্তি বাড়তে থাকলো।আমি বাচ্চা কথা ঠিক মতো বলছে না এটা খেয়ালই করিনি।
৫/৬ মাস বয়সে মা, বাবা,দাদা ডাকত।হঠাৎ কথা বন্ধ করে দেয়।কেন কথাই বলে না।চোখে চোখ রাখে না।অস্থির হতে থাকলো। ডাকলে শুনেই না।অনেকটা অটিজম বাচ্চাদের মতো।
বাধ্য হয়ে শিশু হসপিটালের শিশু বিকাশে দেখালাম।তারা বুঝতে পারলো সমস্যা আছে। তবে এখন থেকেই কেয়ার নিতে হবে।নয়তো এটা অনেক বড় সমস্যা হবে।
বেশ কিছু কাজ দিল আমাকে করতে।স্কুলে ভর্তি করতে বলল।ওর বয়স তখন আড়াই বছর। কাছেই কিন্ডারগার্টেনে দিলাম।তার সাথেই বসে থাকতে হয়।এভাবে একটানা ক্লাসে বসে থাকতে বাচ্চাদের মধ্যে মোটেও ভালো লাগে না।কি যে কষ্ট দায়ক কি বলবো।
আমার হাড় ভাঙা পরিশ্রম যাচ্ছে। কিন্তু আমার পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। মায়ের বাসায়ও কম যাই।গেলেই এক কথা। রাজু কথা বলে না।আমাদের ছেলের নাম রাজু।সবাই তাকে অসুস্থ বাচ্চা মনে করে।সব কিছুর জন্য আমাকে দায়ী করে। কথা গিয়ে কলিজায় গিয়ে লাগত।কেউ সাহায্য করবে না।কিন্তু দশ কথা শুনিয়ে যাবে।
অন্য দিকে শশুর বাড়ির লোকজন তো কম না।যা পারে তাই শুনায়।মানসিক চাপের একটা সীমা থাকে। সব রাগ দুঃখ রাজুর উপর পড়ত।ছেলেটা এত ছোট আর অবুঝ। তবুও মার খেত। খাবার নিয়ে জ্বালায়।ঘুম নিয়ে জ্বালায়।কথা বলে না।আমার কষ্ট আর চিন্তার শেষ নেই।
একটা বাচ্চা মানুষ করতে বাবা শুধু টাকা দিয়ে দায়িত্ব পালন করবে।আর কিছু তার করার নেই। বাকি সব মায়ের কাজ।ছেলেটা বাবাকে খুব পছন্দ করে। বাবা যা বলে বুঝে আর করেও।অথচ রনি রাজুকে একটুও সময় দেয়নি।তার কাজ আর কাজ।আমরা যেন শুধু একটা দায়িত্বের বোঝা।
অনেক কাঁদতাম। কাউকে নিজের মনের কথা বুঝাতে পারতাম না।সবাই আমাকে দোষারোপ করত।আমি কম কথা বলেছি। সময় কেন দেইনি?
একা একটা মানুষ এক হাতে সব করেছি। কেউ বলেনি আহা! চেষ্টা তো করছে।এতটুকু আশার বাণী শোনার জন্য অপেক্ষা করতাম।
ছেলের জন্য মাসখানে গ্রামের বাড়িতে থাকলাম।আমার একটানা গ্রামে ভালো লাগে না।তবুও রাজুর জন্য থাকা।বেশ উন্নতি হল।ধীরে ধীরে রাজুকে নিয়ে যুদ্ধ শুরু করা।কতটা কষ্ট করেছি তা কেউ স্বীকার করবে না।কিন্তু আমি জানি আমার একার জন্য কতটা অসাধ্য সাধন ছিল এটা।
যদি বাবা হয়ে ছেলের সাথে সময় দিত।ছেলেকে কাছে টানত।আমার জন্য সহজ হত।ছেলেটার আরও অনেক উন্নতি হত।আজ আট বছর হল ওর বয়স। কিন্তু এখনো কথা গুছিয়ে বলতে পারে না।তবে কথা বলে।আমি মা আমি তার না বলা কথাও বুঝতে পারি।অন্য কেউ তো সব বুঝতে পারে না।
পড়াশোনায় মাশাল্লাহ খুব ভালো ছাত্র। যা একবার দেখে ভুলে না।অনেক কঠিন শব্দ সে মনে রাখে।ইংরেজিতে খুব পাকা সে।দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে রাজু।পরীক্ষার নম্বরও খুব ভালো আসে।কিন্তু খুব অস্থির স্বাভাবের।কারো কথাই শুনে না।আমার কথা ছাড়া।
অনেকের কাছে রাজু অস্বাভাবিক বাচ্চা। কিন্তু আমার কাছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষ। সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ। সবার সব গুণ থাকে না।
আমাদের আর একটা মেয়ে আছে। ও ছোট হলেও মাশাল্লাহ এত কথা বলে! অবাক হয়ে যাই।তবে আমাদের মেয়ে রুমি হওয়ার পর থেকে রাজুর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক বড় হয়ে গেছে আমার ছোট্ট সোনা বাবাটা।বোনটাকে দেখে রাখে।তার বোন সে বুঝে।
সবচেয়ে বড় কথা রাজু আমাদের সবাইকে অনেক ভালোবাসে।অনেক খেয়াল রাখে।ছোট বোনকে ভালোবাসে।ওদের মারামারি দেখলেও শান্তি লাগে।
ছেলে জন্য খুব কম জায়গায় যাই।মানুষ বিরক্ত হয়।কেমন যেন করে। কষ্ট লাগে। ও এখন অনেক কিছু বুঝতে পারে না। খানিক লজ্জাও পাই।আমরা শিক্ষিত হলেও মনের দিক থেকে বড় হওয়ার অনেক বাকি।
আজ এত দীর্ঘ পথের কথা কেন বললাম? একটা বাচ্চা মানুষ করার দায়িত্ব শুধু মায়ের নয়।বাবারও অনেক কিছু করার আছে। বাবার ভালোবাসা টাও যেন পরিপূর্ণ ভাবে পায়।দুজন মিলে সময় দিলে এমনটা হত না।একটা বাচ্চার জীবন নষ্ট হত না।একটা পরিবার এভাবে চিন্তায় পড়ত না।বাড়ির অন্য সদস্যরাও পারত কাছে আসতে।সাহায্য করতে।কেউ করেনি সাহায্য। সবাই শুধু অপবাদ দিয়েই শান্তি পায়।
আমরা সন্তানদের জন্য কতকিছুই করি।কিন্তু এর মধ্যে সময় দেওয়াটাও জরুরি। মা একা সারাদিন তার সাথে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে যায়।বাচ্চারাও একঘেয়েমি বোধ করে। জীবনের সব কিছু দিচ্ছেন তো একটু সময় না হয় প্রতিদিন দিবেন তাকে।কষ্ট হয় ছেলেটাকে নিজ হাতে শেষ করলাম।
আমার রাগ আমি দমন করতে পারি নাই। ওর মাঝে সেই রাগ আমি আজ দেখি।নিজেকে সামলাতে পারিনি।কারণ নিজেও অস্থিরতার মাঝেই ছিলাম।
তার জীবনটা হয়তো আর দশটা বাচ্চার মতো হবে না।কিন্তু আর দশটা বাচ্চার মতোই তো সে পৃথিবীতে এসেছিল।আমি পারিনি তাকে তার মতো পৃথিবীতে রাখতে।ক্ষমা কি পাব কখনো? একটু সময় সবাই মিলে দেই বাচ্চাদের। অন্তত এক থেকে দেড় বছর ওদের হাতে মোবাইল না দেই।হাতে খেলনা দিয়ে তার সাথে খেলি। যেভাবে আমাদের শিশুকাল আর শৈশব কেটেছে।
আমার লেখায় কতটুকু উপকার কার হবে জানি না।তবে এটা বাস্তব জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষা। যদি কারো কাজে দেয়।ভুলের বোঝা কমান।এ ভুলের ক্ষমা নেই। এ ক্ষতির সমাধান নেই। নানান মানুষের নানান কথা মনকে ভারি করে দেয়।কেউ আশার বাণী শোনায় না।শুধু হতাশায় ডুবায়।
মাঝে মাঝে মনকে বুঝাই একদিন আমার এই ছেলেই অনেক বড় মানুষ হবে।সবাইকে দেখিয়ে দিবে সে কি ছিল।আর আজ কি হয়েছে।সবাই ওর প্রশংসা করবে।বলবে,মা কত কষ্টে ছেলেটাকে ভালো করেছে।একদিন কেউ আমার কৃতিত্ব স্বীকার করবে।আমি বড় আশা নিয়ে বাঁচি।
সে কথা কম বললেও বুদ্ধি তো কম দেয়নি আল্লাহ। নিশ্চয়ই কিছু দিয়েছে ওকে।যা দিয়ে সারাজীবন চলতে পারবে।
নিজেকে শক্ত করুন।নিজের বাচ্চাদের জন্য বাঁচুন। তাদেরকে সময় দিন।তাদেরকে দায়িত্ব না ভেবে ভালোবাসায় বাঁধুন।এমন সন্তানের মা বাবাদের বলল,ধৈর্য ধরুন।সাহস রাখুন।ভালোবাসা দিন পরিবারকে।সন্তানের কিছু হলে মা বেশি হতাশায় ভোগে।
(বাস্তব কাহিনী অবলম্বনে লেখা।)
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

11 thoughts on “একটু সময়

  1. Hi there, i read your blog from time to time and i own a similar one and i was just curious if you get a lot of spam feedback? If so how do you prevent it, any plugin or anything you can suggest? I get so much lately it’s driving me crazy so any assistance is very much appreciated.

  2. I don’t even know how I ended up here, but I thought this post was great. I do not know who you are but certainly you’re going to a famous blogger if you aren’t already 😉 Cheers!

  3. The heart of your writing whilst sounding agreeable initially, did not sit properly with me personally after some time. Somewhere throughout the sentences you were able to make me a believer but just for a very short while. I nevertheless have got a problem with your jumps in logic and one might do nicely to help fill in those gaps. In the event you actually can accomplish that, I could undoubtedly end up being fascinated.

  4. Wonderful beat ! I would like to apprentice while you amend your site, how can i subscribe for a blog site? The account helped me a acceptable deal. I had been tiny bit acquainted of this your broadcast provided bright clear idea

  5. This is really interesting, You’re a very skilled blogger. I have joined your rss feed and look forward to seeking more of your wonderful post. Also, I have shared your web site in my social networks!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles