মতি সারাদিন রিকশা চালায় ঘরে ডুকে শাশুড়ী মাকে দেখে খুশি হলেও চিন্তায় পড়লো। এমনি দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। কামাই রোজগার কম হচ্ছে। যাই হোক দুপুরে তার বউ রাবেয়া কল করে বলেছে মা আইসেছে। ছোট ভাই দিয়া গেছে। পারলে দুধ আর মাছ এইনো। ঘরে খালি দুইডা ডিম আছে।
শাশুড়ী মাকে সালাম দিল মতি। হাসি মুখে কথাও বলল। ঢাকায় এক রুমের বাসা নিয়ে থাকে মতি দুই ছেলে আর বউ নিয়ে। খুব কষ্ট হলেও থাকতে হয়। কিছু করার নাই। যাই হোক মেহমান হলো রহমত। যা পারে তাই করবে।কিন্তু রাবেয়ার জন্য কষ্ট লাগে। মাকে ভালো কিছু খাওয়াতে না পারলে তার কষ্ট লাগবে।
বাহিরে এক কোনায় দুটো গ্যাসের চুলা। পাঁচটা পরিবার তাতে রান্না করে। সিরিয়াল করে রান্না করতে হয়। এখন রাবেয়া একাই রান্না করছে দেখে মতি খুব কাছে যেয়ে বলল
-কি গে এখনো কি এত রান্না করো? মায়ের জন্য কত আয়োজন!
এমন দুষ্ট মিষ্টি কথা বলে মতি সবসময়ই রাবেয়াকে জ্বালায়।এটা রাবেয়াও জানে।জেনেই মিথ্যা অভিমান করে। সেই রাগ আবার মতিকেই কত কসরত করে ভাঙাতে হয়।রাবেয়া অভিমান করে বলে
– দেখ মা কিছুই খাইতে পারে না। এত শুকায় গেছে। ভাবী মনে কয় মায়েরে খেয়াল করে না। মায়ের জন্য ভালো কিছু বাজার করা দরকার। টাকাও তো হাতে নাই।
রাবেয়ার মন খারাপ দেখে মতি একটু হাসাতে চাইল।বলল – কিছু খাইতে পারে না। তো এতকিছুর কি দরকার কও? থাক গা কিছু কিনতে হইবো না। দুধ আর মাছ কিনলাম কার জন্যে?
এবার রাবেয়া রেগে বলল
– হুম আমার মারে দেখে তোমার খুশি লাগে নাই তো। আমার মা যে। তোমার মা হইলে তো বলা লাগে না। বাজার হাজির হয়। মারে কালকাই বাড়িত পাঠায় দিমু।
মতি এবার ঘাবড়ে গেল। তাড়াতাড়ি বলল
– দেখ দেখি বউটা মজাও বুঝে না। আরে মা তো মা’ই। তোমার আর আমার কি? আমার মা আসলে তুমি কি করো নাকি? রাগ করে না। যাও দুধটা ঘন করে জ্বাল দিয়া মারে খাইতে দাও। ভাত দিছো তারে? কি রানছো তার লাইগা?
– কি আর দিতাম? ডিম ছিল আলু দিয়া ভুনা করছি আর শাক ভাজি। মায় আমার হাতের রান্না খুব পছন্দ করে। জোর কইরা খাওয়াইছি। এখন দুধ গরম কইরা দেই।রাবেয়া মৃদু ধাক্কা দিয়ে মতিকে সরিয়ে ঘরে গেল।
মতি মনে মনে খুশি হলো।যাক রাগ হয় নাই পাগলীডা। সত্যি মতি রাবেয়াকে অনেক ভালোবাসে। এত অভাব অনটন। কিন্তু কোনদিন অভিযোগ করে না। ছেলে দুইটারে কতকিছু বুঝায়। যাতে টাকা নষ্ট না করে।পোলাপান কতকিছুই তো কিনবার চায়।কিন্তু রাবেয়া দেয় না। যা দরকার তাই শুধু কিনে।
সকালে মতি আজ একটু তাড়াতাড়ি বের হলো।যদি কিছু টাকা বেশি পায় তো আজ একটা মুরগী কিনবে। শাশুড়ী তো রোজরোজ আসে না। রাবেয়াও খুশি হবে।
সত্যি নিয়ত অনুযায়ী বরকত হয়। আর মেহমান তার রিজিকে যা থাকে তাই পায়। মাসের প্রথম তাই অনেকেই বাজার থেকে পুরা মাসের বাজার করে বাজার থেকে বাসায় যাচ্ছে। দুইজন তাদের বাজার উপরে তুলে দেওয়ার জন্য পঞ্চাশ টাকা করে দিছে। আরও কিছু টাকা হলেই হয়। অন্য দিনের চেয়ে আজ কামাই ভালোই।
এক বয়স্ক লোক বাজার নিয়ে তাকে ডাকলো। বেশ দূরে বাসা। তাই ভাড়াও বেশি পাবে বলে রাজি হলো। তাড়াতাড়ি বাজার রিকশায় তুলে নিল। লোকটা কথা শুরু করলো।অনেকেই রিকশায় উঠে গল্প করে। আবার কেউ কথাই কয় না। বড়লোক মানুষ এমন গরীবের সাথে কি কথা?
লোকটা মতিকে বলল
– তা কি নাম তোমার?
– মতি।
– বাসায় কে কে আছে তোমার?
– জি। বউ আর দুই ছেলে আছে।
– বাহ! বেশ ভালো।
– লোকটাকে দেখে ভালো মনে হলো মতির।তাই জিজ্ঞেস করলো
– চাচা একটা কথা কই?
– হুম।বলো।
-বাজারে মুরগী কত চাচা?
– মৃদু হেসে লোকটা বলল কেজি দুইশ। কেন?
– না মানে।বাসায় শাশুড়ী মা আসছে। তো তার লাইগা। সবসময় তো আহে না। বউটাও খুশি হইবো।কিছু মনে কইরেন না।
– আরে না। তোমার চাচী থাকতেও তার বাপের বাড়ির মানুষ আসলে এমন বাজার করে খাওয়ালে সেই খুশি হত। মেয়ে মানুষ এসব খুব পছন্দ করে। মনে পড়ে গেল।দুই বছর হয়।আমারে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। লোকটার মনে হয় কষ্ট লাগলো।
মতি তার কষ্ট বুঝতে পেরে বলল
– আমার বউ খুব ভালো। কিন্তু অভিমান একটু বেশি।
আমারে সেই ভালোবাসে। কখনো কিছু চায় না। যা দেই তাতেই আনন্দ। অনেক ভালো।
রিকশা থেকে সব নামিয়ে মতি লোকটাকে উপরে বাসায় বাজার দিয়ে চলে আসবে এমন সময় ডাক দিল লোকটা। বাড়তি টাকা না দিয়ে বলল
– এটা রাখো। বউ,শাশুড়ী আর বাচ্চাদের নিয়ে খাবা।
মতি লজ্জায় লাল হয়ে গেল।বলল
– চাচা আমি এজন্য বলি নাই। দুই মাস মুরগী কিনতে যাই নাই। সাহস হয় না। তাই জিজ্ঞায় ছিলাম।আমি কিনতে পারমু।
লোকটা ব্যাগটা মতির হাতে ধরায় দিয়ে বলল
– মুরুব্বিদের কথা শুনতে হয়। যাও বাসায় যাও। তোমার তো আনন্দ করার মানুষ আছে। এটাই সময় তোমার। আমার তো সেই সুখ নাই এখন। তুমি যাও।
মতি বন্ধ হওয়া দরজার কাছে মিনিট দুই দাঁড়ায় থাকলো। ভাবতে লাগলো এখনো এমন মানুষ আছে? মন থেকে দোয়া করলো লোকটার জন্য।
বাসায় গিয়ে মতি বউকে ব্যাগ দিয়ে বলে
– তাড়াতাড়ি রান্না বসাও। মার জন্য ভালো কিছু খাওয়া হইবো। রিজিকের মালিক আল্লাহ।
ব্যাগে পোলাও চাল, একটা মুরগী, একটা পাঙ্গাস মাছ ছিল। মতি অবাক হয়ে গেল। চোখে পানি চলে আসলো। মনে মনে অনেক খুশি হলো আর দোয়া করতে থাকলো।
রাবেয়ার হাতে জাদু আছে। এত ভালো রান্না করে। পেট ভরে সবাই খেল। রাবেয়া মহা খুশি।কিন্তু চিন্তা করে মতি এত টাকা খরচ করলো।রিকশা ভাড়ায় চালায় মতি। ভাড়ার টাকা কি বাকি রাখলো?
বউয়ের চিন্তা মতি বুঝতে পারলো।
তাই বলল
– আরে কি এত ভাবো গো? এক চাচা বাজার কইরা আমার রিকশায় উঠছিল। উনি দিছে।আমি নিতে চাই নাই। খুব জোর কইরাই দিলো।
মতির কথা শুনে রাবেয়াও দোয়া করলো লোকটার জন্য। আনন্দে চোখে পানি আসলো।কত ভালো মানুষ এখনো আছে দুনিয়ায়। জামাইয়ের আয়োজনে শাশুড়ী মা যে মহা খুশি তাও বুঝতে পরলো মতি আর রাবেয়া। মতি আর রাবেয়াও খুশি হলো।
ঐ অপরিচিত মানুষটা অল্প কিছু খাবার দিয়ে একটা পরিবারে সুখ দিল। তার জন্য এটা অল্প কিছু। কিন্তু মতির জন্য অসম্ভব আনন্দের স্মৃতি হয়ে থাকলো। মতির দোয়া লোকটার প্রাপ্য ছিল। আর বউ, শাশুড়ীর দোয়া মতির জন্য ছিল বলেই মতি এতটা সুখ ও আনন্দ পেল। সংসারে অর্থের অভাব থাকলেও যেন ভালোবাসা আর সম্মানের অভাব না হয়।স্বামী স্ত্রীর মধুর খুনসুটি আর ভালোবাসাই টিনের ঘরে সুখের বসত গড়তে পারে।