আপন ছেলের বউও আপন

209933941 503381257617642 1284014363277275972 n
Read Time:13 Minute, 51 Second

রেখা আমার ননদ। মাস ছয় হয় বিয়ে হয়েছে। এর মাঝে দুই বার রাগ করে চলে এসেছে বাসায়। কত শখ করে বিয়ে দিল সবাই। ছেলে ভালো।পরিবারও ভালো।বংশ ভালো। এত ভালো আর হয় না। বিয়ের পরের দিন থেকেই শশুর বাড়ির মানুষের নানানরকম কথা শুরু।

রেখা মেয়ে খারাপ না।বেশ বুদ্ধিমতী আর শান্ত। আমি ওর কাছে থেকে অনেক সময় পরামর্শ নিয়ে চলি। ও যতদিন ছিল আমিও শান্তিতেই ছিলাম। সারা বাড়ি একদিকে ও আমার দিকে।আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলত। কেউ পেরে উঠতনা ওর সাথে। এত যুক্তি দিয়ে কথা বলে। ওর কষ্টে আমারও কষ্ট হয়।দুজন সমবয়সী হওয়াতে খুব মিল ছিল আমাদের। একটাই নন্দ।আর কোন দেবর বা ভাসুর নাই। তাই আপন বলতে এ বাড়িতে রেখা আর আমার স্বামী হাসান। বাকি সব আত্মীয়স্বজন শশুর শাশুড়ী একদিকে।

রেখা ভালোই গুছানো মেয়ে। কাজও মোটামুটি সবই পারে। না পারলে দেখিয়ে নিয়ে করে। মাঝে মাঝে আপসোস হয়।আমার যদি একটা ভাই থাকত।ওকে অন্য কোথাও বিয়ে দিতে দিতাম না। মেয়েটা শশুর বাড়িতে নানান কথায় জর্জরিত।

বাবার বাড়ি থেকে কি কি দিল?মেয়ে সুন্দর, শিক্ষিত।কিন্তু কাজ কম পারে। নানান কথা। এসব তো আছেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে। নতুন বিয়ে হয়েছে কেউ না কেউ দেখতে আসেই। এসে গুণ তো পায় না। যেন দোষের একটা গুদাম সে। কাকে কি বলবে? ঘরে বসে একাই কাঁদে। মাঝে মাঝে মনের কথা আমাকে বলে। যদিও বলতে চায় না। আমি ওর মন হালকা করতে জানতে চাই নিজের থেকেই।

খুব কষ্ট লাগে যখন কোন মেয়েকে তার বাবা মা তুলে বকা হয়। এটা কিছুতেই মানা যায় না। আমি রেখাকে বলেছিলাম তুমি মামুনকে বলো কিছু কথা। ওকে বুঝাও যে বাবা, মা,ভাবী এদেরকে যেন বুঝিয়ে বলে।তোমাকে এভাবে কিছু না বলতে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়েছিল। মামুন খুব ভালো ছেলে।এটা মানতেই হয়। সে রেখার কাছে সব শুনে বলেছিল

– আগে কেন এসব বলোনি আমাকে? তারা তোমাকে পছন্দ করে এনেছে। আমি তো প্রেম করে বিয়ে করিনি। এখন এসব বলে অশান্তি করার কি মানে?

পরের দিন সকালে নাস্তার টেবিলে মামুন সহ সবাই খাচ্ছিল। এমন সময় রেখার শাশুড়ী রেগে বলে

– রেখা রুটি এত বড় আর শক্ত কেন? বাবার বাড়িতে কি রুটি খাওনি কখনো? এভাবে রুটি বানায়? মা কি কিছুই না শিখিয়ে বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে লেগে গিয়েছিল?
রেখার চোখ দিয়ে কষ্টের চেয়ে লজ্জার পানি বেশি পড়তে লাগল। মামুন তার মাকে বলল
– এভাবে বলছেন কেন? খারাপ তো হয়নি। খাওয়া তো যাচ্ছে। আর না পারলে দেখিয়ে দিন। আজ না পারুক কাল পারবে। ওর মা যা শিখিয়ে দিয়েছে তা তো দিয়েছেই। এখন আপনিও মা।বাকিটা আপনি দিবেন শিখিয়ে।খাওয়াবে তো আপনাকেই তাই না?

রেখা বলেছিল ভাবী সবার চেহারা দেখে আমার কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল।আব্বা মামুনকে বলেছিল
– বাঃ বিয়ে করে বউয়ে আঁচলে ঢুকে গেছ বাবা? তা বউ কি সারারাত এসব শিখায়? মায়ের মুখের উপর কথা বলতে লজ্জা লাগল না? কি খারাপ বলেছে তোমার মা? এমন ব্যবহার যেন আর না দেখি। আমি এখনো বেঁচে আছি। এখনই মায়ের সাথে এভাবে কথা বলো! আমি মরলে কি করবে?
– মামুনের মা বলেছিল কেবল শুরু করেছে তারা। আরও কত কি বলাবে ছেলেকে দিয়ে। একদিন বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাবে। এখনকার মেয়েরা এসবই তো করে। রাহাতের ( মামুনের চাচাতো ভাই) বউকে দেখলে না দুই মাসের মধ্যে স্বামীকে নিয়ে বাসা ছাড়লো। মামুন বলেছিল
– মা কোন কথা কোনদিকে নিয়ে গেলেন? এতটুকু কথা এত বড় না করলেও হত।আর রাহাতের বউকে কম কথা বলেনি রাবেয়া চাচী। মাথা খারাপ করে দিয়েছিল। ভাইয়া সংসার করবে তার বউ নিয়ে। তো কি করত এ ছাড়া? আমি চাই রেখা তোমাদের সাথে মিলেমিশে থাকুক। বাড়িতে অশান্তি চাই না মা।

এ নিয়ে রেখাকে অনেক বাজে কথা শুনতে হয়েছে। পরে রেখা মামুনকে আর এসব নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করে। কারণ মামুনের সাথে বাকিদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। সারাদিন কি হয় তা মামুন ফিরলেই তার মা রেখাকে নিয়ে নানান কথা খোঁচা দিয়ে মামুনকে বলে।
সারাদিন পরে বাসায় এসে এসব কথা শুনতে কোন পুরুষেরই ভালো লাগে না। মামুন রেগে যায়।কখনো মা’র উপর রাগ হয়।তো কখনো রেখার উপর। এসব নিয়েই রাগ করে রেখা এর আগেও দুই বার একাই চলে এসেছে। এবার মামুন রাগ করে দিয়ে গেছে। বলে গেছে
– তোমার এত অশান্তির দরকার নাই। তারা কোন কারণে এমন করে জানি না। তাদের তোমাকে দেখতে ভালো লাগে না।এখানেই থাকো।দেখি কি করা যায়।
যদিও এই দূরে থাকা মামুন ও রেখা দুজনের জন্যই কষ্টের।তারা সত্যি একে অন্যকে খুব ভালোবাসে। এত অল্প সময়ে একজন অন্যজনকে অনেক বুঝতে পারে। সবার জীবনে একদিক না একদিকে শান্তি থাকে। রেখার সাথে আমার এই মিলটা আছে। রেখার মন খুব খারাপ থাকে।যার জন্য আমার শশুর ও শাশুড়ীর মনও খারাপ থাকে ইদানীং। হাসানের মনও খারাপ থাকে রেখার জন্য। বোনের সংসারে শান্তি নেই তাই তারও চিন্তা হয়।

একদিন সকালে আমার শাশুড়ী আম্মা বেশ রেগে গিয়ে আমাকে বলল
– সকালে রুটি না করে দোকান থেকে পরোটা আনালে কেন? এতটুকু করতে এত কষ্ট হয়? তো সারাজীবন বাপের বাড়িতেই পায়ের উপর পা তুলে থাকতে। যতোসব অলস মেয়ে মানুষ। আমি বললাম
– আম্মা পেটে ব্যথা করছে। তাই রুটি বানাতে ইচ্ছা করছিল না।আজ খান কাল বানিয়ে দিব।

এর মধ্যে কখন যে রেখা পিছনে এসেছে আমি দেখিনি। রাগে লাল হয়ে গেছে চেহারা। বুঝতে পারছিলাম আজ ঝড় হবে। ও বাড়ির রাগ না এবাড়িতেই ঝারে। যেই কথা সেই কাজ। রেখা তার মাকে বলল
– কি সমস্যা তোমার ? সকাল বেলা এমন করে ভাবীর উপর চিৎকার কেন করছো? একবেলা কেনা রুটি খেলে কি মানুষ মরে যায়? এতে চোদ্দগুষ্টি তুলে কথা বলার কি হলো? ছেলের বউ দেখে মানুষ না? কি মনে হয় ওর এই কথাগুলো কেমন লেগেছে? ভালো করে কথা বললে কি সম্মানে লাগে? ছোট হয়ে যাও বউয়ের কাছে? ছেলে আপন আর ছেলের বউ পরের মেয়ে। তাহলে এই পরের মেয়ে কিভাবে তোমাদেরকে আপন ভাববে?

আমি বুঝতে পারছিলাম এটা শুরু। শেষ করতে দিলে আজ আম্মার খবর আছে। তাই রেখার হাত ধরে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাত ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে দিল। আবার শুরু করল।
– আমি তোমাদের মেয়ে বিয়ে হয়ে চলে গেছি। এখন এটাই মেয়ে।কারণ আমি চাইলেই তোমাদের কোন প্রয়োজন বা অসুস্থতায় ছুটে আসতে পারবো না। কিন্তু ও থাকবে। ওই করবে সব। তাহলে আপন কে? আমি নাকি তোমার ছেলের বউ
Farzana Yasmin
Farzana sent Today at 12:53 AM
সাধারণ কথা বুঝতে এত কষ্ট হয় কেন মা? ওতো সব ছেড়ে চলে এসেছে তোমাদের কাছে। তোমরা আপন না করে নিলে একদিন ঠিকই তোমার ছেলে সহ চলে যাবে।কারণ তারও একটা জগৎ দরকার। সেও বউ,মা হতে চায়।

– শুনো মা কষ্ট পেও না।একটা কথা বলি।আজ অন্যের মেয়ের সাথে এমন করো তাই তোমার মেয়ের সাথেও মানুষ এমন করে। এটা আমার শাস্তি যা তোমরা করছো। তোমাদের কর্মফল আমি ভোগ করছি। আর কোনদিন বাপ মা তুলে কথা বলবে না ভাবীকে।যদি মন চায় দুটো চড় মারবে। তবুও বাপ মা তুলে কথা বলবে না।কারণ তারা তোমাদের খায় না। আমি নিজেও এসব সহ্য করে আসছি। আমি জানি কেমন লাগে কথাগুলো। দাদী তোমার সাথে যা করতো তুমি ভাবরী সাথে তাই করছো। দাদী আর তোমার সম্পর্ক কোনদিনই ভালো ছিল না। তুমি কি চাও তোমার একমাত্র বউ আর তোমার মধ্যেও এমনি সম্পর্ক হোক? আজ ভাবী চলে গেলে তোমাদের এই বয়সে কে দেখবে? এভাবে তাকে ভয় দেখিয়ে আটকাতে পারবে না।
কথাগুলো ওর নিজের মনের ছিল। বুঝতে পারছিলাম।আম্মা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। একসময় দেখলাম চোখ দিয়ে পানি পড়লো। আমি খুব ভয় পেলাম।কষ্টও হচ্ছিল তারজন্য। রেখা আর দাঁড়ালো না। বাসা থেকে বের হয়ে গেল। আমি আম্মাকে বললাম
– আম্মা ক্ষমা করবেন।ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। এতকিছু এতদিন সহ্য করছে।
আম্মা আমাকে বলল
– তুমিও তো এতগুলো মাস সহ্য করলে। যাও তো পাগলটা কোথায় গেল? নিয়ে আসো ওকে। ওকে বলো আমি আর তোমার বাবা মা নিয়ে কিছু বলবো না। যা বলার তোমাকেই বলবো। আম্মা ঘরে চলে গেলেন।বুঝতে পারলাম ওনার কতটা কষ্ট লেগেছে।
জানতাম রেখা ছাঁদে আছে। ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। বলল
– ভাবী সত্যি আমি সবাইকে নিয়ে থাকতে চাই। কাউকে কাছে থেকে আলাদা করতে চাই না। যেমন চাই না আমার বাবা মাকে ছেড়ে ভাইয়া আর তুমি যাও। কেন এমন হয় বলো তো? আমি তো কখনো তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি নাই। তবে কেন আমার সাথেই এমন হলো?

সেদিনের সেই কথাগুলো আমার শাশুড়ীর কানে না কলিজায় গেঁথে গেছে। কারণ সেদিন তার মেয়ের কষ্ট সে দেখেছে। এরপর বকলেও স্বাভাবিক লাগল।কারণ আমার মাও এখনও আমাকে বকে। কিছু দিন পর রেখার শশুর এসে ওকে নিয়ে যায়। সবার কাছে ক্ষমাও চেয়ে গেছে। কারণ মামুন বাড়িতে বলেছিল সে রেখাকে বাপের বাড়িতে দিয়ে সারাজীবনের জন্য বিদেশে চলে যাবে। তার বাবা মা সুখে থাকুক।
তারা ভয় পেয়ে যায়।কারণ মামুন খুব একরোখা। ধীরে ধীরে রেখাও তার শশুর শাশুড়ীকে আপন করতে থাকে। তারাও বুঝতে পারে ছেলের ভালো এখানেই।

সেদিন আমি শশুর বাড়িকে নিজের বাড়ি করে পেয়েছিলাম শুধু রেখার জন্য। ও যা করেছে তা আমার বাবা, মা বা হাসানও পারতো না। একজন মেয়ে অন্য মেয়ের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে। যা অন্য কেউ পারে না।

এমন করে যদি সব মেয়ে তার নিজের সাথে ভাবীর কষ্টও বুঝতে পারতো। তাহলে সব সংসারে সুখ আসতো। জন্মের সম্পর্ক বা রক্তের সম্পর্ক দূরে রেখে একটা অচেনা মানুষের সাথে জীবন কাটাতে আসি আমরা।একটু আপন করে নিলে কতটা সুখ আসে তা যারা আপন করে নেয়।তারাই জানে এর আনন্দ। অশান্তি কি সুখ দেয় কাউকে? এতে কেউ কিছু পায় না।শুধু হারায় সারাজীবন আপনজনকে। আপন ছেলের বউও আপন হয়। যদি আপন করে নেওয়া যায়।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles