মেয়ে সন্তান

IMG 20210814 172503 scaled
Read Time:11 Minute, 54 Second

আজও মেয়ের গর্ভে মেয়ে জন্ম নেওয়া অপরাধ। নীলা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সাকিব মেয়ে পছন্দ করে আর মিতুকেও খুব ভালোবাসে।বাবা তাই মেয়ের প্রতি টান তো থাকবেই। তবে প্রায়ই সাকিবের বাবা মা তার ছেলে না হওয়ার জন্য নীলাকে দোষারোপ করে। নীলা জানে না এতে তার কী দোষ।

নীলা যখন গর্ভবতী ছিল নীলার শাশুড়ি কোন হুজুরের কাছে থেকে যেন তাবিজ এনে দিয়েছিল। কিন্তু নীলা সে তাবিজ পরেনি।ধর্মে এগুলো করা কবিরা গুনাহ। সাকিবও এটা পরতে নিষেধ করে। এজন্যই নাকি মেয়ে হয়েছে নীলার।

নীলার দেবরের বউ সাথীর ছেলে হয়েছে। সেই খুশিতে সবাই আত্মহারা। সাথীর বাচ্চা যখন ছয় মাসের পেটে। তখনই জানতে পারে ছেলে হবে।শশুর শাশুড়ি সে যা খেতে চায় সামনে এনে হাজির করে। মাটিতে পা ফেলতে দেয় না সাথীকে। অথচ নীলার বেলায় সব উল্টো হয়েছে। শাশুড়ি নীলাকে কম কম খেতে বলতো।কারণ বাচ্চা বড় হয়ে যাবে।সিজার করতে হবে।এতো টাকা কোথায় পাবে সাকিব। একটা মেয়ে বাচ্চার জন্য এত খরচ করার কোন মানেই হয় না। এজন্যই নীলাকে সাত মাসের পর বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। নীলার বাবাকে নীলার শাশুড়ি বলে
— আমাদের বাড়ির নিয়ম হচ্ছে প্রথম বাচ্চা বাপের বাড়িতেই হয়। তাই আপনাদের নিয়ম পালন করতে হবে।
নীলার বাবার কষ্ট হলেও মেয়েকে নিয়ে যায়। তার অভাব থাকলেও মেয়ের সুখের চিন্তা সবার আগে।কিন্তু নীলার বাচ্চা নরমালেই হয়।ছোট্ট সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হয় নীলার। সাকিব মেয়েকে কোলে নিয়ে কেঁদে ফেলে। একদম বাবার মতো দেখতে হয়েছে মিতু। এখন তিন বছর বয়স মিতুর। বাবা অফিস থেকে ফিরলেই বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কতো যে আদর দেয়। মেয়ের জন্য সাকিবের মন বাসায় পড়ে থাকে। মেয়ের মধ্যে এতো মায়া তা সাকিব আগে বুঝতে পারতো না। এজন্যই মিতুকে নানা বাড়িতে নিয়ে যায় আবার দুই দিন থেকে নিজের সাথেই নিয়ে আসে। মেয়েকে না দেখে থাকতে পারে না।
সাকিবের এত মায়া দেখে তার মা মাঝে মাঝে বলে
— মেয়ের উপর এতো দরদ দেখিয়ে কী হবে? বিয়ে দিলে পরের বাড়ি চলে যাবে। ছেলে হলে বাবা মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারতো।বৃদ্ধ বয়সের সম্বল হতো। এসএসসি পাশ করলেই বিয়ে দিয়ে বিদায় দিয়ে দিব।
মায়ের এমন কথায় সাকিব হেসে বলে
— তা তো হবে না মা। ওকে ডাক্তার বানাবো। পরের বাড়ি গেলে যাবে। আমার দায়িত্ব পালন করলে করবে না করলে নাই। কিন্তু বাবা হয়ে ওর প্রতি আমার কোন দায়িত্বের অবহেলা করবো না। তুমি যা বলছো তা পুরনো কথা মা।এভাবে কথা বলো না।আমার কষ্ট লাগে।

সাকিবের কথায় মা দমে যায়। তবে নীলাকে কথা কম বেশি শুনতেই হয়। সারাদিন নীলা ঘরের সব কাজ করলেও অসংখ্য অভিযোগ থাকে নীলার নামে।সাকিব অফিস থেকে ফিরলেই নীলার শাশুড়ি একটার পর একটা নালিশ দিতেই থাকে। একদিন সাকিব সব শুনে বলল
— আমি জানি নীলার ভুলের জন্য ওকে সারাদিন যথেষ্ট বলেছো তুমি। আমাকে কেন আবারও বলছো এসব?আর ভুল তারই হয় যে কাজ করে। যে কাজ করে না তার তো ভুল হয় না। ও তো নিজের মতো চেষ্টা করছে। মাস্টার্স পাশ করেও চাকরি করতে দিলে না।বললে ওর মেয়ে কে দেখবে? এখনও সমস্ত সংসারের কাজ করছে। কিছু প্রশংসা করলে ওরতো ভালো লাগে। আরও আগ্রহ হবে সবার জন্য করতে।তুমি সবসময়ই ওর ভুল ধরে কথা বলো।তুমি ভুলে গেছো বাড়িতে আরও একটা বউ আছে। সেও কিছু করতে পারে। তাছাড়া মিতুর পড়ালেখার জন্য নীলার এখন মিতুকেও সময় দিতে হবে। বাচ্চাদের ছোট থেকেই কিছু অভ্যাস করতে হয়। সে সময় তো নীলা পাচ্ছে না মা। তুমিও তো মিতুকে সময় দিতে পারো। তুমি ভুলে যাও মিতু আমার মেয়ে। ও শুধু নীলার মেয়ে নয়।

সাকিবের এমন কথায় শাশুড়ি হতবাক হয়ে যায়। কী বলবে বুঝতে পারে না। কিন্তু সাকিবের ছোট ভাই শিহাব খুব খেপে যায়। সে সামনে এসে বলে।বাঃ আমার বউ বাচ্চা নিয়ে দেখি তোমার আর তোমার বউয়ের অনেক সমস্যা। এতো সমস্যা তো আগে কেন বলনি? ঠিক আছে আমরা চলে যাচ্ছি। এত অপমান সহ্য করবো না আমি। সামান্য কথায় এতকিছু হয়ে যাবে নীলার শাশুড়ি তা বুঝতে পারে নাই। আসলে সেদিন সাকিবের মনে পুষে রাখা কষ্ট বের হয়ে এসেছিল।

বাবা মায়ের হাজার অনুরোধের পরও শিহাব বাসা ছেড়ে চলে যায় শশুর বাড়িতে। পরে শশুর বাড়ির পাশেই বাসা নিয়ে থাকে। বাবা মা’কে দেখতেও আসে না। কিন্তু নীলার শশুর আর শাশুড়ি শিহাবের ছেলেটাকে না দেখে থাকতে পারে না।তাই প্রতি মাসে একবার করে দেখতে যায়।আর প্রতিবারই বাসায় ফিরে আসতে হবে। কিন্তু তারা আর আসবে না বলে দেয়। কারণ সাথী ছেলেকে নিয়ে সংসারের এতো কাজ করতে পারবে না। বাবা মা-ও ছেলে আর ছেলের বউয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে চলে আসে। নীলর শশুর শাশুড়ি শিহাবরা চলে যাওয়ার পর থেকে মিতুকে কাছে টানতে শুরু করে। আর মিতুও দাদা দাদীর আদর পেয়ে খুব খুশি হয়।

হঠাৎ সাকিবের বাবা অসুস্থ হয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। শিহাব দেখতে এলেও সাথী বাচ্চাকে নিয়ে আসে না। এক সপ্তাহে শিহাব একবারই এসেছিল হাসপাতালে। সমস্ত সময় সাকিব আর নীলা ছিল হাসপাতালে। নীলার শাশুড়ির শরীরও খারাপ হয়ে যায় চিন্তায়। তাই তিনি বাসায় ছিলেন। এমন খারাপ সময় নীলার মা বাবা তাদের পাশে ছিলেন। যারা খারাপ সময় পাশে থাকে তারাই আপনজন।

সাকিবের বাবা মা ধীরে ধীরে তাদের ভুল বুঝতে পারে। নীলাকে তার গুণ ও ব্যবহারের জন্য তার শশুর শাশুড়ি ভালোবাসতে শুরু করে। এর মধ্যে আবারও নীলর শশুর হার্ট অ্যাটাক করে। হঠাৎ চিকিৎসার এতগুলো টাকা সাকিব একা দিতে পারছিল না।এজন্য শিহাবকে কিছু টাকা দিতে বলে নীলার শাশুড়ি। কিন্তু শিহাব দিতে পারবে না জানিয়ে দেয়।

সাকিব অফিস থেকে লোন নেয়।তারপরও কিছু টাকা কম পড়ে যায়। নীলা সাকিবকে এমন অবস্থায় ভেঙে পরতে দেখে খুব কষ্ট পায়। তাই নীলা তার সোনার কানের দুল আর গলার চেইন বিক্রি করতে দেয় সাকিবকে। যদিও সাকিব তা নিতে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু নীলার জোরাজুরিতে আর নিরূপায় হয়েই জিনিস গুলো বিক্রি করতে হলো।

নীলার শশুর সুস্থ হয়ে ফিরে এলে যখন জানতে পারে শিহাব কোন টাকা দেয়নি।আর নীলা তার গহনা বিক্রি করে টাকা দিয়েছে। তখন নীলার শশুর আর শাশুড়ি শিহাবের প্রতি রাগ হলেও নীলার প্রতি অসম্ভব সন্তুষ্ট হন।শীলাকে তার শাশুড়ি নিজের গহনা এনে পরিয়ে দেয়।
সেদিন নীলার শশুর বলে
— এতো দিন আমার দুই ছেলে ছিল। আজ থেকে আমার এক ছেলে আর এক মেয়ে। যে সন্তান বাবার এমন কষ্টের সময় পাশে থাকে না।সেই ছেলে দিয়ে কী হবে আমার? এমন মেয়ের মতো ছেলের বউ আছে যার তার ঐ রকম অপদার্থ ছেলের কী দরকার? আমার যা আছে তার ভাগ নীলাও পাবে।আমার মেয়ে থাকলে যা পেত তা নীলার হবে।

নীলা আনন্দে কেঁদে ফেলে। আজ তার সত্যি আনন্দের দিন। এতো বছর পর সে এই বাড়িতে এতো ভালোবাসা আর সম্মান পেল।সে তার শশুরকে বলে
— আব্বা আপনি আমাকে মেয়ে বলেছেন এতেই আমি অনেক খুশি। আমার আর কিছু চাই না। শুধু মেয়ের মতো ভালোবাসা চাই। আমার মেয়ের প্রতি আপনাদের ভালোবাসাই আমার জন্য অনেক কিছু। শুধু দোয়া করবেন বাবা।আমার মেয়ে যেন সত্যিকারের মানুষ হতে পারে।
নীলার শশুর মিতুকে কোলে নিয়ে বলে
— এ বংশের মেয়ে সে, মানুষ তো তাকে হতেই হবে।যার বাবা মা এমন দায়িত্বশীল।তাদের সন্তান অনেক বড় হবে।আমি আছি না? সব দায়িত্ব আমার এখন।

এক বছর পর নীলা আবারও মা হয়। একটা সুন্দর ছেলে সন্তান হয়। এবার নীলার আদরের কমতি ছিল না। ছেলের মা হবে বলে না। এ বাড়ির মেয়ে বলে।আর মিতুর আদর কিন্তু একটুও কমেনি। এখন মিতুর দেখাশোনা মিতুর দাদা দাদী করে। কারণ মিতুর ছোট ভাই মাহিনকে নিয়ে তার মা এখন খুব ব্যস্ত। মিতুও কিন্তু অনেক ব্যস্ত তার সাথে গল্প বলতে খেলতে। সংসারটা এখন সুন্দর ভালোবাসায় সাজানো আর পরিপাটি। কারো ঘরের মেয়ে এসেই একটা সংসার সাজায়। মেয়ে ছাড়া কী ঘর সংসার হয়? একটা মেয়েই তো ঘর আলো করে রাখে। মেয়েদের মতো মায়া কী কারো মনে আছে? সংসারের সবাইকে আপন করে নিতে হয় সবার। পর ভাবলে কেউ আপন হতে পারে না। সংসারের সুখ শান্তি সবার ভালোবাসার উপর নির্ভর করে।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles