গল্প -ঃ রিমার আত্মবিশ্বাস (তৃতীয় পর্ব)

image editor output image2128355256 1631130995956
Read Time:15 Minute, 29 Second

রিমা তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এবার সম্পূর্ণভাবে বুটিক হাউজ খুলেই ছাড়বে।যদিও সে জানে না এতে সফল হবে কিনা। তবুও এবার হাল ছাড়বে না। আসিফ এগুলো জানতে পারার পর থেকেই অনেক ঝামেলা করছে। সে কিছুতেই রিমাকে ঘরের বাহির হতে দিবে না। বিশ বছর পর কোনকিছু নতুন করে শুরু করতে সাহসও কম লাগে না। রিমা তার অল্প অল্প করে জমানো টাকা দিয়ে এবার তার স্বপ্ন পূরণ করবে। মিশা মায়ের বুটিক হাউজের নামও ঠিক করেছে “স্বপ্ন ঘুড়ি”। নামটা রুমা আর মাহিনের খুব পছন্দ হয়েছে। কারণ এটা রিমা আর তার সন্তানদের স্বপ্ন। মা হিসাবে রিমা সত্যি সফল মানুষ। তার সন্তানদের সে সত্যিকারের মানুষ বানাতে পেরেছে।

রিমার প্রথমেই দোকান দিয়ে বুটিক হাউজ শুরু করার সামর্থ্য নেই। তাই গেস্ট রুমে বুটিক হাউজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।অনলাইনে সব কাজ চলবে। আর যদি কেউ শোরুমে থেকে কিনতে চায়।তো বাসার ঠিকানা দেওয়া হবে।তবে তা শুধু মাত্র মহিদের জন্য। কারণ শুধু মহিলাদের পোশাক থাকবে।কিন্তু কীভাবে কোথায় থেকে কাপড় কিনবে বা তৈরি হবে।এটা নিয়ে চিন্তায় ছিল রিমা। ভাগ্য ভালো বলেই একটা সুযোগ পেয়ে গেল। মিশার বান্ধবী তনুর মায়ের বুটিক হাউজ ছিল। তার কানাডা যাওয়া কনফার্ম হওয়ার জন্য বিজনেস বন্ধ করে দিল। রিমা তনুর মায়ের সাথে যোগাযোগ করলো। উনি সব ড্রেস বিক্রি করতে পারেনি।এদিকে যাওয়া সময় হয়ে গেছে। মাত্র এক মাস হাতে। তাই উনি গোছানো আর অন্য কাজে ব্যস্ত। রিমার বুটিক হাউজ খোলার কথা শুনে খুব খুশি হলো। উনি তার বাকি থাকা ড্রেসগুলো রিমাকে দিতে চাইলেন।আর সেটা একদম কেনা দামে। আর রিমার অবস্থার কথা জানতেন উনি। তাই তিন মাস সময় দিলেন। আর টাকা তনুর নানিকে দিয়ে যেতে বললেন। রিমা তনুর পরিবারকে চিনত।তাই আর কোনো সমস্যা হবে না বলে খুব খুশি হলো। রিমা ছেলে মাহিনকে নিয়ে তনুর বাসা থেকে সমস্ত ড্রেস গুলো নিয়ে এলো। কিন্তু শুরু হলো নতুন বিপদ।

আসিফ বাসায় এসে এগুলো দেখে রেগে আগুন হয়ে যায়। মুখে যা না তাই বলে বকতে থাকে রিমাকে। মাহিন সামনে এসে বলে, তুমি মা’কে মায়ের মতো থাকতে দেও। সে তার মতো নিজের জন্য কিছু করতে চায়।তাছাড়া আমরা এখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছি। সবাই এখন নিজের জন্য কিছু না কিছু করে। আর তুমি তো মায়ের সাথে নেই। তার কোনো বিষয়ে তোমার এমন মতামতের কোনো দরকার আছে কী? এই প্রথম মাহিন বাবার সামনাসামনি হলো তাও তার মায়ের জন্য।

মাহিন তার বাবাকে বলল, কাজের মধ্যে থাকলে মা ভালো থাকবে। মায়ের তো আমাদের জন্য কোনকিছু করা হলো না। তার লেখাপড়া করে আমাদের পিছনে সমস্ত সময় দিল।তারও কতো স্বপ্ন ছিল।চাকরি করার তো বয়স নেই। একটা ছোট করে বুটিক হাউজ খুলবে।এখানে সবকিছুই মহিলাদের জিনিস থাকবে। আর এটা বাসায় গেস্ট রুমে হচ্ছে। বাহির থেকে শুধু ড্রেস কিনে এনে বিক্রি করা হবে। তুমি বাঁধা দিচ্ছো কেন?
আসিফ রিমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাঃ ছেলেকে সব শিখিয়ে দিয়েছ। আজ পর্যন্ত কোনদিন আমার সামনে এসে কথা বলার সাহস হয়নি। আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে তোমার হয়ে কথা বলে।তাও আবার ব্যবসা করতে চাও। আমি কী কম টাকা দেই তোমার সংসারে? কোনটার অভাব তোমার শুনি? নাকি এখন বাহিরে সুখ খুঁজে পেয়েছো? এসব করলে এখনে থাকতে পারবে না। আমার বাসা থেকে চলে যাবে। আর যদি বাচ্চারা যথেষ্ট বড়োই হয়ে গেছে তাহলে তুমি চলে গেলেই পারো। সেদিন তো বললে বাচ্চাদের জন্য এখানে পড়ে আছো। তোমাকে আমারও টানার ইচ্ছা নাই। অনেক হয়েছে। শুধু এসবের জন্যই আমার অন্য পথ খুঁজে নিতে হয়েছে। মনে রেখো আমার কথার বাহিরে গেলে আমি তোমাকে ভাত কাপড় দিয়ে রাখবো না। এসব রঙ তামাশা আমার বাসা থেকে চলে গিয়ে করো। কথা না শুনলে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হব আমি।

রিমা আসিফের সব কথা শুনে বলল, ঠিক আছে। দিয়ে দেও ডিভোর্স। আমিও মুক্তি চাই। তোমার আমার মাঝে পাঁচ বছর আগেই সব শেষ হয়ে গেছে। কাগজে কলমে বাকি একটা স্বাক্ষর। এটাও হয়ে যাক। আমিও এই বোঝা টানতে পারছি না। আর চাই না এমন নরকের জীবন। এখন যাই করবো নিজের জন্য করবো।কারোর কোনো কথায় আমার কিছু যায় আসে না। তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারো। আর
সন্তান তোমার একার না।আমি জন্ম দিয়েছি ওদের। আমি মা ওদের। আমি সারাজীবন ওদের সাথে থাকবো।আলাদা করার কোনো অধিকার তোমার নাই। মায়ের অধিকার সবার উপরে। তুমি কীভাবে ওদেরকে আলাদা করবে তাই দেখবো এবার। তুমি এতবছর আইন আদালতের ভয় দেখিয়েছ আমাকে। এবার আমিও দেখতে চাই। তুমি কীভাবে আমার সন্তানদের থেকে আমাকে আলাদা করো?

আসিফ বাচ্চাদের সামনে রাগের মাথায় রিমাকে চড় মারে। আসিফ আর মিশা সাথে সাথে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাবাকে আসিফ বলে, তুমি আর একবার হাত তুললে আমি পুলিশ ডাকবো। তুমি মায়ের গায়ে হাত দেও কীভাবে? আমরা মা’কে ছাড়া এখানে থাকবো তুমি ভাবলে কী করে? এই পাঁচ বছর টাকা ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব কী তুমি পালন করেছো? আমাদের জন্য শুধু কী টাকার দরকার ছিল? আমাদের অসুর বিসুখ, পড়ালেখা সবকিছুর দায়িত্ব মা একা পালন করেছে। আমরা বড়ো হয়েছি বলে মা’কে লাগবে না এটা বলো কীভাবে? তুমি কী তোমার মা’কে বড়ো হওয়ার পর ছেড়ে এসেছো? মা যেখানে আমরাও সেখানে থাকবো। আমাদেরকে আলাদা করতে পারবে না। তুমি তো আমাদের সাথে থাকো না। আমাদের জন্য তোমার ভালোবাসা থাকলে এভাবে দূরে যেতে পারতে না। তুমি যদি আমাদের দায়িত্ব আর পালন করতে না চাও সমস্যা নেই। আমরা চালিয়ে নিব নিজেরটা।

রিমা সন্তানদের সামনে কষ্টে আর লজ্জায় নীরবে কাঁদছে। আসিফ রিমাকে বলল, আমার খেয়ে পড়ে ছেলেকে নিজের পক্ষে কথা বলতে শিখিয়েছো। এর ফল ভালো হবে না। এটাই যদি শেষ কথা হয় তাহলে আমিও এর শেষ দেখে নিব। তোমার এত আরামের জীবন শেষ হলে বাস্তব টের পাবে। তোমরা সবাই বুঝতে পারবে কষ্ট কাকে বলে। বাস্তব সম্পর্কে কোনো ধারণাই নাই তোমাদের। এত আরাম সহ্য হচ্ছে না। ঠিক আছে আমি দেখতে চাই আমাকে ছাড়া কীভাবে চলে তোমাদের। ডিভোর্স দিলে রাস্তার শিয়াল কুকুরের মুখে পড়বে। সব বুঝতে পারছি আমি। নতুন কাউকে জুটিয়ে নিয়েছো। তা নাহলে এত বছর পর এত সাহস কোথায় থেকে পেলে?
রিমা মিশা আর মাহিনকে ওদের ঘরে চলে বলে।

এবার রিমা সামনে এসে আসিফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, একদম বাজে কথা বলবে না। আমি তোমার মতো চরিত্রহীন না। কারো হাত ধরতে হলে তোমাকে একেবারে ছেড়ে গিয়ে ধরবো। আর তোমার সাথে সংসার করে সব শখ পূরণ হয়ে গেছে। ঘৃণা এসে গেছে মনে। তোমার সাথে সংসার করে কী পেলাম? ধোঁকা দিয়েছো আমাকে। আমার বিশটা বছর নষ্ট করে দিয়েছো। এমন অবস্থা করেছো আমার যাতে কোনদিকে যেতে না পারি। তবে আমি এবার আর নিজেকে তোমার কাছে বন্দী করে রাখবো না।আমি এই কষ্ট আর তোমার অপমানের বোঝা টানতে পারছি না। তুমি ডিভোর্স দিলেও আমি এবার আর থামবো না।আর বাচ্চাদের তুমি আমার কাছ থেকে আলাদা করতে চাইলেও পারবে না।তুমি ভুলে যেও না আমি তাদের মা।আমি আমার সবকিছু দিয়ে ওদের জন্য করেছি। তোমাকে পাঁচ বছর আগেই ছেড়ে দিতে পারতাম। শুধু ওদের জন্য তোমার এত অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছি।আর কোনো কিছু সহ্য করবো না। আর আজ থেকে আমার কোনো দায়িত্ব তোমার পালন করতে হবে না। তুমি শুধু মিশা আর মাহিনের দায়িত্ব পালন করো।ওরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত শুধু।

রিমার কথা শুনে আসিফ বলল, যে সন্তান বাবার মুখে মুখে তর্ক করে।মায়ের পক্ষে কথা বলে বাবাকে অপমান করে তাদের জন্য আমার আর কিছু করার দরকার নাই। অনেক করেছি।তুমি যেই আদালতে পারো অধিকার আদায় করো।আর এমন নষ্ট মেয়ে মানুষ নিয়ে আমি সংসার করবো না। একটা স্বাক্ষর বললে না? এটাও দিয়ে দিব।নিজের পথ খুঁজে নেও।সাথে তোমার বাচ্চাদেরও।

আসিফ চলে গেল। তার শেষের কথা গুলো রিমাকে চিন্তার সাগরে ডুবিয়ে দিল।শুধু রিমাকে নয় মিশা আর মাহিনের দায়িত্ব একা কীভাবে রিমা পালন করবে? এখনো তো কিছুই শুরু করতে পারলো না। আসিফ যা বলে তাই করে। রিমা জানে আসিফ রিমাকে শাস্তি দিতে সত্যি ডিভোর্স দিবে।আর বাচ্চাদের খরচও দিবে না।হাতে সময় নেই। কী করবে রিমা তাই ভেবে কাঁদতে লাগল।

রাতে রিমাকে তার মা কল করলো। রিমাকে তার মা স্পষ্ট করে বলে দিল যদি রিমা এসব বুটিক করার চিন্তা বাদ না দেয় আর আসিফ যদি ডিভোর্স দেয় এসবের জন্য। তাহলে রিমা বেঁচে আছে না মরে গেছে তার খবর তারা রাখবে না। সমাজে বা আত্মীয়স্বজনের কাছে তারা মুখ দেখাতে পারবে না। এমনিতেই আসিফের জন্য মাথা নিচু হয়ে গেছে তাদের। এমন জামাই বংশে একটাও নেই। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের ডিভোর্স হয়নি। রিমা তার মাকে বলল, এই পাঁচ বছর একই কথা বলে গেলে।আমার খোঁজ নিতে কয় দিন এসেছো তোমরা? বাচ্চাদের দোহাই দিয়ে এই সংসার করতে বললে। কেউ পাশে দাঁড়ালে না।কবে কল করে জানতে চেয়েছো কেমন আছি? তুমি তো মা ছিলে আমার। আমার কষ্ট তো তোমার বেশি বোঝার কথা ছিল। তোমারা আমার কষ্ট কেউ বুঝতে চাওনি। এখন আমার বিষয় আমার উপর ছেড়ে দেও।

একটু পরে রিমার শাশুড়ি কল করে সেও একই কথা বলল।রিমা এসব বন্ধ না করলে আসিফ রিমাকে ডিভোর্স দিবে। বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে রিমার জন্য। বাহিরে পুরুষ মানুষের সাথে কাজ তো করতেই হবে।এগুলো আসিফ চায় না। ঘরের বউ যেন ঘরেই থাকে। মাথার উপর ছাঁদ আছে এখন।পরে কী হবে তা তারা জানে না। রিমাও তাকে বলে দিল। সে আর এসব সহ্য করতে পারছে না।মুক্তি চায় এই সম্পর্ক থেকে। রিমার শাশুড়িও তার চরিত্র নিয়ে নানান কথা শুনিয়ে দিল। এই বয়সে এইসব করার মানে কী তারা সেটা বুঝতে পারছে।

সবদিক থেকে সবাই রিমাকে দোষারোপ করেই যাচ্ছে। কিন্তু রিমা এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছিল।বাচ্চারা একটু বড়ো হলে সে তার নিজের জন্য কিছু করবে।নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করবে।আসিফের কাছ থেকে মুক্তি নিবে।এই দোটানা জীবন তার চাই না। আর সহ্য করতে পারছে না। ধৈর্য যেন সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। আসিফ তো যে কোনো সময় রিমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে। আর পাঁচ ছায় বছর পর রিমার কিছুই করার থাকবে না।তখন কোথায় দাঁড়াবে রিমা? রিমা তার সন্তানদের জন্য মজবুত হতে চায়।নিজেকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চায়। আর তিলে তিলে মরতে চায় না রিমা।তার স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চায়।সে এখন আর সমাজকে ভয় করে না। আপন বলতে আজ সন্তানরা ছাড়া আর কেউ তার নেই। তা তো সে এই পাঁচ বছরে বুঝতে পেরেছে।

কয়েকদিন পর একা চিঠি এলো।রিমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে আসিফ। হঠাৎ যেন রিমার পায়ের নিচের মাটি সরে যেতে লাগল। মানুষটা সত্যি শেষ পর্যন্ত এটা করলো!

চলবে,,,

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles