গল্প -ঃ রিমার আত্মবিশ্বাস ( চতুর্থ ও শেষ পর্ব )

IMG 20210728 203044
Read Time:16 Minute, 54 Second

রিমা এই দিনের অপেক্ষায় ছিল। কারণ সে আর এতকিছু সহ্য করতে পারছিল না।আসিফের ব্যবহার দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছিল। বাচ্চাদের সামনে এত বাজে আচরণ আর মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু বিশ বছরের এই সাজানো সংসারের মায়া রিমা কেন, কোনো মেয়েই সহ্য করতে পারতো না। রিমা সবকিছু জানার পরও আসিফকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করেছিল। অনেক বার ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিল।কিন্তু পারেনি। বারবার আসিফ চরম ঘৃণা নিয়ে ওকে ফিরিয়ে দেয়। রিমা আশা করেছিল আসিফ তার ভুল স্বীকার করবে।রিমার সাজানো সংসারে ফিরে আসবে। বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজেকে সংশোধন করবে। এজন্য সবকিছু জানার পরও প্রথম একটা বছর রিমা আসিফকে শান্ত ভাবে সবকিছু বুঝাতে চেয়েছিলো।কিন্তু আসিফ রিমার কোনো কথাই মানতে রাজি হয়নি। এটাকেই হয়তো মেইল ইগো বলে।

ঘরের মেঝেতে বসে রিমা কাগজগুলো খামচে ধরে বসে কাঁদছে। মা’কে খুঁজতে এসে মিশা রিমাকে এভাবে দেখে ভয় পেয়ে যায়। মাহিনকে ডাক দিয়ে আনে। মাহিন এসে কাগজগুলো দেখলো। রিমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে বলল, মা ভেঙে পড়লে তো হবে না। তুমি তো জানতে বাবা এমনটাই করবে এখন। জানি তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ঐ মানুষটার জন্য তোমার কষ্ট লাগার কোনো মানেই হয় না মা।

রিমা কান্নায় ভেঙে পড়ে। বারবার বলতে থাকে, আমার বিশ বছরের সম্বল শুধু এই সংসার আর তোমরা।আমার যে আর কোনো জমা পুঁজি নেই। আমি যে কখনো এই সংসারের বাহিরে কিছু চিন্তা করিনি। বিশটা বছর আমি তিলে তিলে এই সংসার গড়েছি। একটা মানুষের মনে কত রাগ আর জেদ থাকতে পারে? আমাকে নিঃস্ব করে রেখে চলে গেছে। অথচ আজও অধিকার দাবী করে আমার উপর। কিসের অধিকার তার আমার উপর? যে আমার সমস্ত জীবন ধ্বংস করে দিয়ে গেল।

রিমা কথা বলতে বলতে হঠাৎ জ্ঞান হারায়। মিশা খুব ভয় পেয়ে যায়। মাহিন মায়ের মুখে পানির ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। রিমা বিরবির করে কি যেন বলতে থাকে।মাহিম একবার আসিফকে কল দিতে চায়। কিন্তু মায়ের এমন অবস্থার জন্য যে দায়ী তার কাছে সাহায্য চাওয়ার কোনো দরকার নেই। বাধ্য হয়ে মাহিন তার নানাকে কল দেয়। নানা সব শুনে তাড়াতাড়ি আসছে বলে জানায়।

রিমাদের পাশের ফ্লাটে একজন সোমা নামের মহিলা ডাক্তার থাকেন। রিমার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক তার। মাঝে মাঝে তার বাচ্চাকে রিমার কাছে রেখে যায়। মাহিন তার বাসায় যায় খোঁজ নিতে।ভাগ্য ভালো সোমাকে পেয়ে যায় মাহিন।মায়ের এমন অবস্থার কথা বলাতে, সাথে সাথেই চলে আসে রিমাকে দেখতে। সব শুনে বলে মানসিক আঘাতের জন্য এমন হয়েছে। চিন্তা করা যাবে না।আমি ঔষধ লিখে দিচ্ছি নিয়ে আসো।আর তোমার মা’কে খাইয়ে দেও। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে।আমি আজ বাসায় আছি। সত্যি অনেক উপকার হলো আজ সোমাকে পেয়ে রিমার।কারণ বাচ্চা দুটো খুব ভয় পেয়েছে।

রিমার মা বাবা আসে। রিমাকে এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে তারা খুব কষ্ট পায়।আদরের ছোট মেয়ে ছিল রিমা। অনেক দেখে শুনে ধুমধামে বিয়ে দিয়েছিল আসিফ আর রিমার। এমন কিছু হবে তা কল্পনাও করেনি। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রিমার মায়ের আজ সত্যি মায়া হলো। বিয়ের পর মেয়েটাকে পর করে দিয়েছে। এত বিপদ গেল বারবার মেয়েকেই দোষ দিয়েছে। রিমাকেই মানিয়ে নিতে বলেছে।এটাই ওর জীবন এখন তাই বুঝিয়েছে। মেয়েটা শুধু বেঁচে আছে আজ।তাও জীবন্ত লাশ হয়ে।

মিশা নানিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। নানুকে বলে, নানু মায়ের কিছু হবে না তো? মা ভালো হয়ে যাবে তো? মা ছাড়া আর কেউ নেই আমাদের। বাবা আমাদের সাথে থাকে না। আমাদেরকে ভালোবাসে না।মা’কে বলো কথা বলতে।আমাদের মা ছাড়া আর কেউ নেই।

রিমার বাবার কলিজাটা ছিঁড়ে যায় নাতনির কথা শুনে। আজ নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। নিজের মেয়ে আর এত ছোট দুই বাচ্চাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে কোনো দায়িত্ব পালন করেনি তারা।বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে দিয়েছে। মেয়ের কষ্ট না বুঝে সমাজ আর নিজের পরিবারের কথা ভেবেছে।অন্য ছেলে মেয়েদের সম্মানের কথা চিন্তা করে রিমাকে তাদের কাছে জায়গা দেয়নি। তার এত কষ্টে মানুষ করা শিখিত মেয়েটার জীবন নষ্ট হওয়ার জন্য তারাও তো আজ দায়ী।কেন সেই সময় ওকে নিয়ে গেল না? আজ বাবা মা আছে রিমার।কাল তারা না থাকলে রিমার কী হবে? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বাচ্চাদের নিয়ে? রিমার বাবার চোখেও আজ পানি।প্রচন্ড রাগ নিয়ে রিমার বাবা আসিফকে কল করে।

আসিফ বুঝতে পারেনি আজ এতদিন পর রিমার বাবা তার মেয়ের জীবন নষ্ট করার জন্য সঠিক জবাব দিবে।রিমার বাবা আসিফকে বলল, এতদিন তোমার মতো অমানুষকে জেলে দেওয়া উচিত ছিল আমার।মিথ্যা সম্মানের ভয়ে এতদিন চুপ ছিলাম।আজ আমার মেয়ের এই অবস্থার জন্য তুমি দায়ী।আমি তোমাকে দেখে নিব।তুমি কী ভেবেছ,রিমা একা? রিমা একা না।রিমার বাবা এখনো বেঁচে আছে। এবার তোমাকে আমার আসল ক্ষমতা দেখাবো।তুমি ডিভোর্স চাও তাই না।হিসাব করে রাখো।রাস্তায় বসাবো তোমাকে।

আসিফ প্রথমে রিমার বাবার মুখে এমন কথা শুনে চুপ করে থাকে।কিন্তু পরক্ষণেই রেগে যায়। আসিফও রিমার বাবাকে জানিয়ে দেয়, সেও দেখে নিবে তারা কী করতে পারে। ডিভোর্স তো রিমাকে দিবেই।বাচ্চাদের কোনো দায়িত্ব সে নিবে না।রিমা বাচ্চাদের নষ্ট করেছে। এখন তার কাউকেই চাই না।তার মেয়েকে যেন সে নিয়ে চলে যায়। এইসব বোঝা এখন তার না বলে দেয়।আর সে এটাও বলে দেয়, বাসা সে ছেড়ে দিয়েছে। তাই তারা এখানে এই কয়দিন থাকলেও আগামী মাসে বাসা যেন ছেড়ে দেয়।আর খালি হাতে যেন বাসা থেকে চলে যায়। তার সবকিছু যেন যেমন আছে ঠিক তেমনি যেন থাকে।

রিমার বাবা আসিফের কথা শুনে অবাক হয়।এত বছর ধরে মেয়েটা তার সাজানো সংসার ছেড়ে কি করে যাবে? রিমার মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর কাঁদছে। তার বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে একেবারে পর করে দিয়েছিল। কত কথা বলল সেদিন রিমাকে।

রিমার বাবা মেয়েকে সত্যি খালি হাতে নিয়ে যাবে ঠিক করে। সাথে তার আদরের নাতি নাতনিকেও নিয়ে যাবে।মেয়ে এতটাই মজবুত করে দিবে যাতে আসিফ কেন কারো সামনে গিয়ে সাহায্য চাইতে না হয়। রাতে মিশা আর মাহিনকে তাদের খাতা বই সব গুছিয়ে নিতে বলল।

সকাল হলে রিমা তার বাবা রিমাকে দেখে খুব অবাক আর খুশি হলো।সারারাত গভীর ঘুমে ছিল ঔষধ খাওয়ার জন্য। রিমা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।বাবা পরম আদরে রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, মা রে আমাকে ক্ষমা করে দিস। তোর কাছে অনেক আগেই আসা উচিত ছিল আমার। তোকে অনেক কষ্ট দিলাম।আজ নিয়ে যাবো তোকে।এখানে তোকে শেষ হতে দিব না।তোর দায়িত্ব আমার। যেমন ছোট বেলায় ছিল। মিশা আর মাহিনের জন্য তোকে শক্ত হতে হবে। আমি তোকে এতটাই মজবুত দেখতে চাই যেন আসিফ তোর সামনে দাঁড়াতে না পারে।তোর সাথে তোর দুই সন্তান আছে। আমি তোর অধিকার তোকে ফিরিয়ে দিব।

রিমা যাওয়ার সময় বারবার তার সাজানো সংসার দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ছিল। বিশটা বছর এই ঘরটাই তার জগৎ ছিল। বাহিরের দুনিয়ায় খবর সে জানত না। আজ থেকে তার নতুন পথ চলা শুরু হবে। দুই সন্তানকে নিয়ে রিমা জানে না কীভাবে বাকি জীবন কাটাবে।তবুও সাহস করে এই নরক থেকে বের হয়ে যাচ্ছে বাবার হাত ধরে। ছোট বেলায় ঠিক যেভাবে বাবা সব রাস্তা চিনিয়ে হাত ধরে নিয়ে যেত ঠিক সেভাবে। মিশা আর মাহিনও কাঁদছে সত্যি
এক অদ্ভুত কষ্টে সবাই ঘিরে আছে। রিমা সাথে নিয়ে যাচ্ছে তার বিশ বছরের আনন্দ আর কষ্টের স্মৃতি। তার বুটিক হাউজের জিনিস গুলো ছাড়া আর কিছু সাথে নেয়নি রিমা।

বাবার বাড়িতে এসে রিমা আর কথা না বাড়িয়ে আসিফকে ডিভোর্স দেয়। রিমার ভাই ভাবিরা মোটেও খুশি হয়নি রিমার বাবার এই সিদ্ধান্তে। এমনকি রিমার বোন দুলাভাইরাও নানান রকম কথা বলা শুরু করে। রিমার জন্য তাদের মানসম্মান নষ্ট হলো। মানুষকে কী বলবে? উঠতে বসতে রিমাকে নানা ধরনের কথা বলে খোঁচা দিত সবাই। তবে তাদের কথার উত্তর দিত রিমার বাবা মা। রিমা নীরবে কাঁদে আর মনকে শক্ত করে। বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে সাহস আনে মনে। আত্মীয়স্বজনেরা রিমাকে দোষারোপ করে সবকিছুর জন্য। রিমা কারো কোনো কথার জবাব দেয় না। সত্যি আজ এসব নিয়ে ক্লান্ত সে।

রিমার বাবার সম্পত্তির যে ভাগের অংশীদার রিমা। সেটা রিমাকে দিয়ে দেয় তার বাবা। আর রিমার বুটিক হাউজের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকাও দেয়। ব্যবসার সমস্ত কাজগ পত্র তৈরি করে দেয়। রিমা প্রথমে বাসা থেকে অনলাইনে তার বিজনেস শুরু করে। শুরুতে তেমন না আগালেও।মাস ছয়েক পরে খুব ভালো যেতে শুরু করলো। সবাই রিমাকে উৎসাহ দিতে লাগল।রিমার দুই বছর পর এখন একটা শোরুম হয়েছে। বাবার বাসার কাছেই রিমা বাসা ভাড়া নিয়েছে। প্রতি দিন রিমা তার বাবার সাথে বিকালের চা খায়।আর বুটিক হাউজের গল্প করে। রিমার বাবা মুগ্ধ হয়ে সেই গল্প শুনে। মনটা খুশিতে ভরে যায় তার।মিশা আর মাহিন নিজেদের পড়ালেখার পাশাপাশি মা’কেও সাহায্য করে।

রিমা তার বুটিক হাউজ থেকে লাইভে আসে। ড্রেসের কালেকশন নিয়ে লাইভ করে নিজেই। অগোছালো রিমা এখন বেশ পরিপাটি হয়ে গেছে। প্রতিটি লাইভের শেষে রিমা তার জীবন থেকে কিছু কথা সবাইকে বলে। যে শিক্ষা জীবন তাকে দিয়েছে তা সে সবার সাথে শেয়ার করে। যাতে রিমার মতো মেয়েরা হেরে না যায়। নিজেকে শেষ করে না দেয়। নতুন করে বাঁচার সাহস পায়। রিমা বলে, যেখানে সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে না সেখানে নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করে নিজের সম্মান ধরে রাখতে হবে।

আসিফ, মাহিন আর মিশাকে দেখতে চাইলেও তারা যেতে চায় না।তবুও রিমা তাদেরকে তাদের বাবার সাথে সম্পর্ক রাখতে বলে।কারণ সে চায় না বাবা নামের মানুষটাকে তারা ঘৃণা করুক। এই কষ্ট অনেক বেশি যন্ত্রণা দিবে বাচ্চাদের। মাঝে মাঝে দেখা করে আসিফের সাথে বাচ্চারা। আসিফ হয়তো কোনদিনই তার ভুল স্বীকার করবে না। রাগে বাচ্চাদের সাথে যা করেছে তার জন্য একদিন ঠিকই অনুতপ্ত হবে এটা মনে করে রিমা।

অতীতকে মনে করতে কেউ চায় না। তবুও সুখের মাঝে অতীতের কষ্ট ব্যথা দেয়। সন্তানদের বুকে জড়িয়ে রেখে আজ রিমার অনেক শান্তি আর সুখ। রিমা হেরে যায়নি।তার পরিবার শেষ সময়ে হলেও হাল ধরে তার। আজ রিমার এই সাহস আর শক্তি এসেছে তার বাবা মায়ের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে চলতে চলতে। আজ রিমা একজন স্বার্থক মানুষ। যার আত্মসম্মান বোধ আছে। রিমার আত্মবিশ্বাসী মন রিমাকে আজ স্বাবলম্বী করে তুলেছে। তা না হলে বিশ বছর ঘরে বন্দী থেকে আবারও পথ চলা অনেক কঠিন। রিমা আজ তার স্বপ্নের মতো জীবন কাটায়। আজ দুই সন্তান সহ তার ছোট্ট সংসার। এখানে বিলাসিতা না থাকলেও সুখ আছে। অসম্মানের গ্লানি টানতে হয় না। আজ রিমা সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত নারী। যাকে অনেকেই সম্মান করে ভালোবাসে।তাকে অনুসরণ করে আগাতে চায় জীবনে।

কেউ ছেড়ে যাওয়া মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়।
কেউ ধোঁকা দেওয়া মানেই নিজে হেরে যাওয়া নয়।
সমাপ্ত

(সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও আন্তরিক ভালোবাসা জানাই গল্পটার সাথে থাকার জন্য। সমাজে এমন ঘটনা অনেক আছে। শুধু পারিবারিক সাহায্য আর ভালোবাসা পেলেই জীবনটা অন্য রকম হতে পারে। তিলে তিলে ধ্বংস হয় রিমার মতো মেয়েদের জীবন। জীবন্ত লাশ হয়ে পড়ে থাকে সংসারে। তারাও নতুন করে পথ চলতে পারে। যদি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস ও ভালোবাসা দেওয়া যায়।)

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles