জীবন ফিরে পাওয়া

211105768 316062553508013 8532230054563703548 n
Read Time:11 Minute, 44 Second
শিশির হসপিটালের বিছানায় অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে আছে। তার বাবা আবদুল মতিন বসে আছে পাশে।মেয়ের ফ্যকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কত দরূদ, কত সূরা পাঠ করে যাচ্ছে। চোখের অশ্রু আজ বাঁধ মানে না।বাবাদের কাঁদতে নেই। এই নিয়ম অমান্য করে বাবা কাঁদছে।
কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে বলে গেল।আর কোন ভয় নেই। শিশিরের শরীর বিষ মুক্ত। মেয়েটার কত কষ্ট হয়েছে এটা ভেবেই তার কান্না চলে আসলো।উনি ডক্টরকে বললেন,
কখন বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবো?
ডক্টর আগামীকাল বলে চলে গেলেন।
কতক্ষণ ডক্টরের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ছিলেন জানেন না তিনি।হঠাৎ শিশিরের কথায় তার মনে হলো কেউ ডাকছে।
শিশির ডাকছে।বাবা,আমাকে পানি দেও।বাবা মেয়ের মুখে কথা শুনে সস্তি পেল।পানি নিজের হাতে খাইয়ে দিল।
শিশির ভয়ে ভয়ে বাবাকে বলল,আমার উপর অনেক রেগে আছো না?বাবা কোন কথা বলতে পারলো না।হাইমাউ করে কেঁদে দিল।পাশের সবাই বুঝতে পারলো।এক বাবা তার মেয়ের জন্য কতটা ব্যাকুল।
শিশির বাবার হত জড়িয়ে ধরে বলল,বাবা তুমি কেঁদ না।আমাকে মারো কাটো।যাই করো কেঁদ না।আমি আর কখনো এমন করবো না।এ পৃথিবীতে তোমার চেয়ে ভালো তো কেউ বাসতে পারে না।এটা ভুলেই গেছি।
বাবা চোখ মুছে বলল,কথা বলিস না।শুয়ে থাক তোর কষ্ট হচ্ছে।
বাবা তো মেয়ের কষ্টের চেয়ে বড় কষ্ট হয়তো আর কিছুতেই পায় না।নিজের মায়ের পরে একমাত্র মেয়েকেই বাবারা মা ডাকে।কতটা গভীর সে ডাক।কতটা মায়া সে ডাকে।
শিশির বাবার হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে শুয়ে পড়লো। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
মারে তুই হওয়ার পর থেকে তোকেই তো মা ডাকি।তোর চেহারা ঠিক তোর দাদীর মতো।কোথাও অমিল নেই। ২০ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছি।তোকে পেয়ে মনে হয়েছে, তোকে আমার মা করে পাঠিয়েছে আল্লাহ।
আমার দুই ছেলেকে যতটা না ভালোবাসি।তারচেয়ে বহুগুণ বেশি তোকে ভালোবাসি।তোর কোন শখ আল্লাদ আমি অপূর্ণ রাখিনি।আজ একটা ছেলের জন্য বাবাকে ফাঁকি দিতে চাস?
আমি বেঁচে থাকবো আর তুই আমার কাঁধে দুনিয়ায় ছাড়বি তা কি করে হয়? আমাকেই বিষ দিয়ে মারতি।
শিশির এবার ছোট বেলার মতো বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে বাবা।কার জন্য বাঁচবো আর কার জন্য মরবো বুঝতে ভুল হয়ে গেছে।
শিশির চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো।কত কি মনে পড়ছে আজ।মনে হচ্ছিল এই পাঁচ বছর নিজেকে ফাঁকি দিয়েছে।
শিশিরের সাথে পাঁচ বছরের সম্পর্ক তারিক নামের এক ছেলের।চাকরি হলেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠাবে তারিক তার বাবা মাকে শিশিরের বাড়িতে।
শিশির এ কি করল! তার এলাকার বড়লোক বাবার মেয়েকে বিয়ে করে বড় পোস্টে চাকরি নিল।
শিশিরকে জানায়নি পর্যন্ত। যেদিন তারিকের বন্ধু এসে বলল।সেদিন বিশ্বাস হয়নি।ছুটে গেছে তারিকের কাছে।তারিক অজস্র আজেবাজে কথা বলে শিশিরকে।
প্রেম করলেই কি বিয়ে হয়? তাছাড়া শিশিরকে বিয়ে করলে কি পাবে সে? মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েকে কি আর দিবে বাবা ভাইয়েরা? পড়ালেখা শেষ করতেই তো সব শেষ করে দেয়।
শিশির শুধু তারিকের শার্টের কলার ধরে বলেছিল,পাঁচটা বছর নষ্ট করলে আমার তার হিসাব দেও।বাবাকে তোমার কথা বলেছি।বাবা তোমাকে দেখতে চেয়েছে।এতগুলো বিয়ে এসেছে শুধু রাজি না হয়ে বলেছি। তোমাকেই বিয়ে করব।তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।
তোমার জন্য কি করিনি বলো? শুধু সংসার করিনি।বিয়ে করিনি।তোমার প্রতি সব দায়িত্ব পালন করেছি। তোমাকে রান্না করে খাইয়েও দিয়েছি।তোমাকে মনে মনে স্বামীর স্থান দিয়েছি।
আজ কিভাবে পারলে এতটা অকৃতজ্ঞ হতে?
আমাদের কোন স্মৃতিই কি মনে নেই তোমার?
কোনদিন কি সত্যি আমাকে ভালোবাসে ছিলে?
নাকি এতগুলো বছর শুধু ব্যবহার করে গেলে?
তারিক শিশিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল,আমাকে আর কিছুতেই পাচ্ছো না।আমার বিয়ে হয়ে গেছে। তোমার সাথে কোন নষ্ট সম্পর্ক রাখতে চাই না।চলে যাও।আর কখনো তোমার চেহারা দেখাবে না।
শিশির আজ তারিককে চিনতে পারছে না।যে তারিক তাকে না দেখলে অস্থির হত।এটা কি সেই মানুষটা!তারিকের দিকে অশ্রু ভরা চোখে শিশির বলল,
এখন কি নিয়ে বাঁচবো?
কার জন্য বাঁচবো বলো?
তারিক শিশিরকে বলে গেল বাঁচতে না পারলে মরে যাও।আমাকে ছেড়ে যাও।আমার সুখ নষ্ট করবে না?
শিশির ভাবলো আমাকে ছাড়া সুখে আছে তারিক।আমি মরে গেলেও তার কিছু না।বাবাকে কি বলবো? কাকে নিয়ে বাঁচবো?কত-শত স্বপ্ন তারিককে নিয়ে দেখা। তাকে ছাড়া কি করে বাঁচবো?
হাজারো কষ্ট অপমান বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আর বাঁচা সাধ হয় না শিশিরের।
বিষের বোতলটা কিনে এনেছে বাড়ি ফেরার পথে।কিছু না ভেবেই খেয়ে ফেলল। তারপর কি হলো জানে না।
বাড়ির সবাই ওকে ডেকে সাড়া না পাওয়ায় দরজা ভেঙে ওকে বের করে। পড়ে মেঝেতে পড়ে থাকা বিষের বোতটা দেখতে পায় সবাই ।তাড়াতাড়ি কাছেই হসপিটাল থাকায় বেঁচে যায়।
এবার বাবার হাত ধরে শিশির বলে,বাবা তারিক অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছে।বড়লোকের মেয়ে বাবা। বড় চাকরি পেয়েছে ঐ মেয়ের বাবার জন্য। আজ আমার মতো মধ্যবিত্ত মেয়ের কোন প্রয়োজন নেই তার।আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
বাবা মেয়ের কষ্ট বুঝতে পারছে।বাবা বলল,কিন্তু তোর বাবার তো তোকে প্রয়োজন আছে। তোর মা মারা যাওয়ার পর কত কষ্টে তোদের তিন ভাই বোনকে মানুষ করেছি। আমার সবকিছু তোদের জন্য শেষ করেছি। তোদের কোন কষ্ট দেইনি।তোকে সব থেকে বেশি আদর দিয়েছি।তুই ছোট আল্লাদের।তোর দুই ভাই তোকে কতটা ভালোবাসে।
সবার ভালোবাসা কম মনে হলো মা? এক ছেলে সব কিছু হল।আমরা কি কিছুই না রে মা?আজ এই বয়সে তোকে এভাবে দেখব বলে কি সারাজীবন কষ্ট করলাম? এই প্রতিদান দিলি রে মা?
বাবার কথায় শিশির সত্যি এবার বুঝতে পারল।কার জন্য সব ছেড়ে পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছিল ও? যে অপমান করে মরতে বলে গেল?
আমি আমার বাবা ভাইদের ছেড়ে যেতে চাচ্ছিলাম শুধু একটা প্রতারকের জন্য? যারা আমার সবকিছু তাদের এতটা অবহেলা করে চলে যাচ্ছিলাম আমি?
বাবা কত স্বপ্ন বুনে রেখেছে।কত কিছু পরিকল্পনা করে আমার বিয়ে নিয়ে।একমাত্র মেয়ে আমি। মা ছাড়া মেয়েকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে।
বড় ভাই কত ভালোবাসে।মাসের বেতন পেলেই আমার পছন্দের খাবার আনে।ছোট ভাই কত অভিমান করে কতকিছু বলে।বড় বলে,সারাজীবন তো তুই খাবি।ও আর কত দিন এ বাড়িতে?
ছোট ভাই কি কম আদর করে? টিউশনির টাকা পেলে ১০০০ টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়।বলে যা মন চায় কিনিস।আমি এতটা স্বার্থপর হলাম একটা অমানুষের জন্য। সবাইকে এমন পর করেছি কবে?
যারা আমার জন্য জীবনের সিড়ি হয়ে থাকল।যারা নিজের কথা না ভেবে আমার জন্য করে গেল।আমি তাদের কষ্ট দিলাম।ওপারে কি সুখ হত?ওপারে কি মা আমাকে ক্ষমা করত?
কার জন্য এত ভালোবাসা ছিল আমার? কার জন্য এতগুলো বছর ছিল? যাকে এত যত্ন করে রেখেছি সে কতটা অবহেলা করে ফেলে গেল।অমানুষটার জন্য যতটা করেছি তার অর্ধেকও যদি বাবা আর ভাইদের জন্য করতাম।কিছুটা মানসিক শান্তি পেতাম।কিছুটা ঋণ পূর্ণ হত।
নিজেকে শোধরাতে শোধরাতে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,বাবা আমাকে ক্ষমা না করে অনেক বকা দেও।অনেক মারো।কিন্তু আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না।আমি আর তোমার কথার অবাধ্য হব না।তোমার সিদ্ধান্তই আমার ভবিষ্যৎ হবে বাবা।
আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার সবকিছুই তোমার। তাই আমার ভালো মন্দ সব ভাবার অধিকার তোমার। আর এমন কোনদিনই হবে না বাবা।এ জীবন শুধু আমার না।আমাদের চার জনের বাবা।
পিছনে দাঁড়িয়ে দুই ভাই শিশিরের কথা শুনছিল।ওরাও এগিয়ে এলো।বাবা আর দুই ভাই শিশিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। এ এক জয়ের কান্না। ছোট বোন আর মেয়েকে সেই ছোট্ট খুকি করে খুঁজে পাওয়ার কান্না।
কিছু ভুল কখনো শুধরানো যায় না।সেই সময় অনেকে পায় না।আমাদের জীবন আমাদের একার নয়।এ জীবনে অনেকের অধিকার আছে। যে তোমাকে চায় না।তার জন্য জীবন তুচ্ছ করে অন্য যারা তোমার জন্য বাঁচে তাদেরকে অবহেলা করবে না।পরকালে কি আছে তা জানো তো? একাকীত্ব আর অভিশাপের শাস্তি।
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles