গৃহিণী

.jpg
Read Time:14 Minute, 32 Second
মাসুম প্রতিদিন ঘরে ঢুকেই একি কথা বলে, ঘর এত এলোমেলো কেন? একটু গুছিয়ে রাখা যায় না? কি অবস্থা করে রাখো তোমরা।
ওর এই কথার নতুন কোন জবাব থাকে না আমার কাছে। বাসায় ছোট দুটো বাচ্চা। সারাদিন ঘরের মধ্যেই থাকে।কোন খেলার মাঠ নেই। বাহিরে কোন বন্ধু নেই। এই ঘরটা ওদের জগৎ। এখানেও যদি হাজার নিষেধ বারণ থাকে তাহলে কোথায় যাবে? তবুও যে কিছু বলি না এমন নয়। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়।বকা দেই বা একটা দুটো মাইরও খায়। কিন্তু বাচ্চা মানুষ গুছিয়ে তো খেলে না।
সারাদিন বাচ্চাদের খাওয়া, গোসল, ঘুম, পড়ালেখা, তো আছেই। রান্না করা কম যুদ্ধের কাজ নয়।রান্নার আগে আধাঘন্টা যায় ঠিক করতে কি রান্না করব? তারপর রান্নার সবকিছু গুছিয়ে কেটে ধুয়ে রান্না বসানো। বারবার দেখা লাগে ঠিক মত হচ্ছে কিনা। এখকার বাচ্চাগুলো এত বিচ্ছু আর অলস কেন? আমরা তো এমন ছিলাম না। মা ভাত দিত খেয়ে উঠতাম। এখন আমার আট বছর আর তিন বছরের দুটোকেই খাওয়াতে হয়। নিজের হাতে খায় না।রাগে যদি সারাদিন না খাওয়ায়ও রাখি তবুও খাওয়ার কথা বলে না।এদিকে আমি মা ওদের না খাইয়ে কি করে গিলি?
বিকালে নাস্তাও লাগে। মাসুম বাচ্চাদের বাহিরের খাবার খাওয়া একদম পছন্দ করে না।আমিও চাই না।তাই কেক,নুডুলস বা অন্য কিছু করে রাখতে হয়। এটাও তো কাজ তাই না? এত কিছু করে সারাদিন যখন জান যায় যায় অবস্থা তখন মাসুমের এই অবজ্ঞা ভরা কথা গুলো সুচের মত বুকে বিঁধে।
ছোট বাচ্চাটা আমি খেতে বসলে পটি করবে। তখন খাওয়া বাদ দিয়ে উঠে তাকে নিয়ে বাথরুমে বসে থাকতে হয়। আবার এসে ঐ ভাত খেতে সেই অভক্তি লাগে। তবুও খাই কারণ পেটে খিদা।গোসলে গেলে বাহিরে দাঁড়িয়ে কান্না করে। বা দুই ভাইবোনের মধ্যে মারামারি লাগে।তাড়াহুড়ো করে গায়ে সাবান না দিয়ে বের হয়ে যাই। নিজের চেহারার দিকে প্রতিদিন তাকানোর সময় হয় না। রূপচর্চা তো দূরের কথা। কতদিন পার্লারে যাই না।
মাস্টার্স পাশ একটা মেয়ে জানপ্রাণ দিয়ে সংসার করছে।কিছুটা কৃতজ্ঞতা তো রাখো। নিজের কোন শখ তো নাই মনে হয়। প্রতিদিন একই রুটিন।বিরক্ত লেগে যায়। আজ সারাদিন বাচ্চা দুটো অস্থির করে রেখেছে। মেজাজ চরমে ছিল। মাসুম ফ্রেশ হয়ে বসে বলল, চা দেও।বাহিরে নাস্তা করে এসেছি। ভাত দেরি করে খাবো।
আমি সোফায় বসে বললাম, প্রতিদিন আমি চা করি।আজ সারাদিন তোমার বাচ্চারা অনেক বিরক্ত করেছে। মাথা ধরে আছে। আজ তুমি চা করো দেও একটু। আমার কথায় তার মাথায় আকাশ পড়লো। হা করে তাকিয়ে আছে। বলতে ভুলে গেছি আমার শাশুড়ী মা বাড়ি থেকে এসেছেন এক সপ্তাহ হয়। আমার কথা উনি পিছনে দাঁড়িয়ে শুনেছেন।
সামনে এসে বললেন, নিজে না পারো।আমাকে বলতে বউ। আমার ছেলেটা সারাদিন অফিসে খেটে আসে।তাকে তুমি কি করে বলো এই কথা? তোমার বাবা তোমার মাকে কাজ করে দেয়।তাই বলে কি আমার ছেলেকে এমন আঙুলের উপর নাচাবে? এক নিঃশ্বাসে সব বলল।
মাথার রক্ত এবার আরও গরম হল। আমি বললাম, কথা আমাকে শোনাতে পারেন।আমার বাবাকে না। আমার মা অনেক অসুস্থ। তার মাজার হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে। নিচে বসতে পারে না। বাবা যতটুকু পারে সাহায্য করে মাকে। আর আমার বাবা সারাজীবন আমাদের সাথে সময় কাটিয়েছে। মায়ের কাজে সাহায্য করেছে। এটা শিক্ষনীয় বিষয়। এত হাদিস জানেন আপনারা এটা জানেন না স্ত্রীর কাজে সাহায্য করা ধর্মে আছে? নবীজি করতেন জানে না?
আর সারাদিন আপনার ছেলে কাজ করে তা আমি জানি।স্বীকারও করি।সম্মান ও করি তার কষ্টকে, কাজকে।কিন্তু আপনারা মনে করেন সারাদিন আমি পায়ের উপর পা দিয়ে খাই। সব কাজ জীনেরা এসে করে দেয়। আলাদীনের চ্যারাক আছে আমার কাছে। এই কয়দিন দেখছেন বাচ্চারা কি পরিমাণ জ্বালায়।এক ঘর কতবার গুছিয়ে রাখি। ছোট মানুষ বুঝে না।রাগ করলে কান্না করে।
আর মা আমার শশুর কোন কাজে আপনাকে সাহায্য করেনি বলে ছেলেকেও কিছু শেখাননি। কিন্তু নিজে তো বুঝতেন একা সব করা কত কষ্টের। ও অফিস থেকে এসে বাচ্চাদের একটু পড়াতে পারে। বা সময় দিতে পারে।কিন্তু তা সে করে না।বসে টিভি নিয়ে। এক খবর চোদ্দ পনের বার দেখে।
তার উপর রান্না এমন কেন? এটা কি হল? এমন অগোছালো কেন? সারাদিন কি এমন কাজ করো? আমার কথা হল তো সব কাজ কে করে দিয়ে যায়?
নিজের বলতে কোন সময়ই পাই না।এক চা তিনবার গরম করে খাই।চা খেতে গেলেও শত কাজ।ও সারাদিন এক টেবিলে বসে কাজ করে। আর আমি সারা ঘর দৌড়ে বেড়াই। কিন্তু আমি তো তাকে বলি না সারাদিন কি কাজ করো?
ও আচ্ছা আমি তো এতকাজ করে টাকা পাই না। তাই আমার কাজের দাম নাই। সে কাজ করে সংসার চালায় তো সেই সব মর্যাদা পাবে। ভালো কথা কাল থেকে টাকা না দিলে কাজ করবো না তার সংসারের।
হিসাব নেও কত টাকার কাজ করি আমি। তোমার বাচ্চাদের জন্য সারাদিন যে আয়া হয়ে দেখাশোনা করবো তার আট হাজার।প্রতিটি কাজ আট শত টাকা। কারণ যে বাচ্চাদের দেখবে সে অন্য কাজ করবে না।তাই ঘর মুছা, প্লেট বাসন মাজা,কাপড় ধোয়া চব্বিশ শত টাকা। আর রান্নার জন্য আলাদা চার হাজার টাকা। এগুলো যে আয়ারা কাজ করে তাদের বেতন অনুযায়ী বললাম।আমার মত মাস্টার্স পাশ মেয়ের বেতন দেওয়ার ক্ষমতা তোমার নাই। রাজি হলে সকালে বলো। সাতারাত ভাবতে থাকো। মাসুম বুঝতে পারল অন্য সব দিনের মত আজ আমার রাগ নয়।বিষয়টা সিরিয়াস হয়ে গেল।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে মাসুম বলল, আরে এত রাগ হচ্ছো কেন? চা খাবে তো করছি। দরকার হলে মাথায় তেলও দিয়ে দিচ্ছি। মাথা ঠান্ডা হবে। আর মা তুমি শুধু শুধু এত কথা কেন বললে ওকে? তুমি তো চা খাওনা। তা বানাবে কি করে? তুমিও না মা?
আমি বললাম, এসব কথা কানে যাচ্ছে না আমার। যা বলেছি তাই হবে। না পোষালে বলে দিও আমি বাবার বাসায় চলে যাবো। এখনো চাকরি পাবো। বাচ্চাদের তুমি রাখবে। এরা তোমার বাচ্চা। বাপের বাড়ি থেকে আনিনি। আর কোন কথা হল মা।রাতে খেয়ে কোন কথা না বলে শুয়ে পড়লাম।
সকালে উঠে মাসুম বলল, কি গো উঠো।আমার কাপড় ইস্তিরি করা নাই। উঠো তো এবার।কি শুরু করলে তুমি? ভালো হবে না বলছি।
আমি তাকিয়ে বললাম, খারাপটা দেখিয়ে যাও প্লিজ। যাতে আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
এবার আমার শাশুড়ী মা এসে বলল, কি গো বউ উঠে রান্না করো। খালি মুখে পুরুষ মানুষ ঘর থেকে বের হতে নেই। আমারও ডায়বেটিস আছে। খেতে যদি না দেও তো চলে যাই।
আমি বললাম, মা এটা আমাকে না বলে আপনার গুণধর ছেলেকে বলেন। টাকা কামাই করে সে।কাজেই সব কাজ তো সেই করে। আমি তো সারাদিন আঙুল চুষি তাই না?
মাসুম এবার বলল, কি চাও তুমি?
আমি হেসে বললাম, তা তো গতরাতে বলে দিয়েছি। মনে নাই তো রেকর্ড করে দেই? আমার কাজের পুরা টাকা চাই। তা না হলে সব কাজ বন্ধ। আর বুয়াদের সাথে যেমন ক্যাচক্যাচ করা যায় না। আমার সাথেও করা যাবে না। তাছাড়া মাসে তিনদিন আমি ছুটি চাই। যেমন বুয়া পায়। ভেবে দেখ।
মাসুদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। দারোয়ানকে দিয়ে নাস্তা পাঠিয়ে দিল। যাই হোক সকাল গেল। দুপুর বেলা মাহিম (আমাদের ছেলে) আর শাশুড়ী মাসুমকে কল দিয়ে বলল এখন কি খাবো?
মাসুম মাকে তো রান্না করতে বলতে পারে না। তাহলে এ কথা রাষ্ট্র হয়ে যাবে। দারোয়ান কে দিয়ে মোড়ের হোটেলে কল দিয়ে খাবার কিনে পাঠালো। দুপুর তো গেল।
মাসুম ইদানীং বেশ রাত করে আসে। রাত এগারো টা বেজে যায় আসতে আসতে। বাচ্চাদের একদম সময় দেয় না।আমারও কত কথা জমে থাকে। বলা হয় না।গত দুই সপ্তাহে শুক্রবারও বাসায় থাকেনি।বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেছে। বাচ্চারা কত কাঁদল ঘুরতে যাওয়ার জন্য কর্ণপাতই করল না।
আজ হঠাৎ আট টায় চলে এলো। হাতে এক গুচ্ছ গোলাপ। আমার পছন্দের চাইনিজ খাবার আর আমার অতি পছন্দের নীল জামদানী শাড়ি। আমি খুব খুশি আর আবাক হলেও বুঝতে দেইনি।
আমার হাত ধরে বলল, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। সত্যি অনেক করো তুমি। তোমার কাজে এখন থেকে সাহায্য করবো। যতটুকু পারো করো। আর সত্যি তোমার নিজের খেয়াল রাখার সময় পাও না। একটা বাঁধা লোক নিবো। বাচ্চাদের পড়া আমি এসে দেখবো।শুক্রবার সম্পূর্ণ দিন শুধু তোমাদের। তুমি বুয়া না।এ সংসারের রাজরানী তুমি। আর মা কাল যা বলেছে তার জন্য আমি ক্ষমা চাই। কিছু মনে করে না।
আমি তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। সত্যি জানো এই কথা গুলোই আশা করেছি সবসময়ই। আমার কষ্ট বুঝবে তুমি। আমার কাজের সম্মান করবে। আর মা যা বলেছে তোমাকে বুঝাতে করেছে।
সব বুদ্ধি মা দিয়েছে। সেও চায় তার ছেলে ঘরমুখো হোক। বাহিরের টান নাকি বড্ড খারাপ। পুরুষ মানুষের বউ বাচ্চাদের প্রতি টান থাকতে হয়।
মাসুম আমাকে জড়িয়ে ধরে চুলগুলো ঠিক করে বলল, হুম।বউ শাশুড়ী মিলে জব্দ করলে আমাকে।আজ তোমাকে জব্দ না করে ছাড়ছি না। যাও শাড়ি পড়ে এসো।খাবো তারপর একান্তে কিছু দেওয়া নেওয়া হবে। তুমি খুব হিসাব শিখেছো আজকাল। সেগুলো পুষিয়ে দেই। দেনা পাওনা না রাখাই ভালো।
আমি বেশ তার দুষ্টুমির ইঙ্গিত বুঝতে পারছি। তাকে ছাড়িয়ে বললাম, মা’র কাছে থেকে জানতে হবে। কি করবো এখন।আমি বলেই পালিয়ে গেলাম।
মাসুম এখন অনেক কাজে সাহায্য করে। বাচ্চাদের সাথে খেলে।না হয় ওদের পড়ায়। শুক্রবার বিকাল হলে সবাই মিলে ঘুরতে যাই। অসম্ভব সুন্দর সময় কাটে। নিজেই বাচ্চাদের নিয়ে অনেক কিছু গুছায়।
মা কিন্তু এসব দেখে খুব খুশি হলেন। উনি বেশি দিন এমন বন্দী হয়ে ঢাকায় থাকতে পারেন না। তাই আজ চলে যাচ্ছেন। মাসুমের হাতে আমার হাত দিয়ে বললেন, এটা আমার বংশের আমানত যা তোকে দিয়ে গেলাম। মৃত্যুর পর কবরে যেন আল্লাহকে বলতে পারি আমি তোদেরকে ভালো শিক্ষা দিয়েছি।নয়তো তোদের পাপের ভাগীদার আমিও হবো বাবা।
মা চলে গেছেন চার বছর হলো। কিন্তু মাসুম তার কথা ভুলেনি। আমার জীবনের কাছে যে অভিযোগ ছিল তার ক্ষমা মাসুম চেয়ে নিয়েছে। আর তার ভালোবাসায় আমার সিক্ত আঁখি ছলছল করে আনন্দে। আজ সত্যি কোন অপূর্ণতা নেই। কোন ক্ষোভ নেই। কোন আক্ষেপ নেই গৃহিণী হতে।
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

25 thoughts on “গৃহিণী

  1. I have been absent for a while, but now I remember why I used to love this website. Thanks, I?¦ll try and check back more often. How frequently you update your site?

  2. I?¦m now not sure the place you’re getting your info, however great topic. I must spend some time finding out much more or working out more. Thank you for fantastic info I was in search of this information for my mission.

  3. Hey There. I found your blog using msn. This is a very well written article. I’ll be sure to bookmark it and come back to read more of your useful info. Thanks for the post. I will certainly return.

  4. This design is spectacular! You most certainly know how to keep a reader entertained. Between your wit and your videos, I was almost moved to start my own blog (well, almost…HaHa!) Fantastic job. I really enjoyed what you had to say, and more than that, how you presented it. Too cool!

  5. certainly like your web-site however you need to take a look at the spelling on several of your posts. A number of them are rife with spelling issues and I to find it very bothersome to inform the truth however I will definitely come back again.

  6. Lottery Defeater Software: What is it? Lottery Defeater Software is a completely automated plug-and-play lottery-winning software. The Lottery Defeater software was developed by Kenneth.

  7. What Is LeanBiome? LeanBiome is a natural weight loss supplement that reverses bacterial imbalance in your gut microbiome with the help of nine science-backed lean bacteria species with Greenselect Phytosome, a caffeine-free green tea extract crafted with patented phytosome technology.

  8. Nice read, I just passed this onto a friend who was doing some research on that. And he just bought me lunch since I found it for him smile Therefore let me rephrase that: Thanks for lunch! “The guy with the biggest stomach will be the first to take off his shirt at a baseball game.” by Glenn Dickey.

  9. Usually I do not read post on blogs, but I would like to say that this write-up very forced me to try and do it! Your writing taste has been surprised me. Thank you, quite nice post.

  10. There are certainly a variety of details like that to take into consideration. That may be a nice point to carry up. I offer the thoughts above as common inspiration but clearly there are questions like the one you deliver up the place a very powerful factor will likely be working in honest good faith. I don?t know if best practices have emerged round issues like that, but I am sure that your job is clearly recognized as a good game. Both boys and girls really feel the impression of just a second’s pleasure, for the rest of their lives.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles