কোণঠাসা

210242139 143501511120765 2499728303685145989 n1
Read Time:8 Minute, 2 Second
নিজের বাস্তব ঘটনা
গতবছর যখন লক ডাউন শুরু হলো। তখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। যেমন বুয়া বাদ দিয়ে একা সব কাজ করা খুব কষ্টের। অন্য দিকে জামাই এই এগারো বছরে ঘরের কাজে যা সাহায্য করেনি।তা একেবারে পুষিয়ে দিচ্ছিল।ঘর পরিষ্কার করা।কিছু থালাবাসন ধুয়ে দেওয়া বেশ ভালো লাগছিল।কাজের চাপে সময় কম দিত।এখন ২৪ ঘন্টা একসাথে। খারাপ লাগতো না। মনে হচ্ছিল জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় পাড় করছি। মরে গেলেও আফসোস থাকবে না।সকাল বিকাল একসাথে বসে চা খাওয়া। দারুণ অনুভূতি। বাচ্চারাও বাবাকে বাসায় পেয়ে মহা আনন্দ।
কিন্তু সময় বুঝি অন্য রকম হিসেবে করছিল। হঠাৎ করেই শরীর কেমন খারাপ হয়ে গেল। জ্বর জ্বর লাগে।কিন্তু জ্বর নেই। পরের দিন লক ডাউন থাকার স্বত্তেও সে কাজে বাহিরে গেল।আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার। এত জমানো টাকা কই? বাসা ভাড়া,খাওয়া দাওয়া আরও কত কি।পরের দিন দুপুরে জ্বর এসেই গেল। ভয়ে মনে যাই।করোনা হলো না তো?
চারিদিকে শুধু খারাপ খবর। হসপিটাল গুলো নিয়ে নানা রকম অনিয়মের অভিযোগ। ওকে বলছিলাম,আমাকে কি হসপিটালে যেতে হবে? বলল আরে না।বাচ্চারা আছে। তাদের জন্য আলাদা থাকো।পরিচিত একজন ডক্টর আছে আমাদের। ধন্যবাদ তাকে।যতটা সম্ভব সাহায্য করেছেন।উনি প্রেসক্রিপশন দিলেন।
কষ্ট শরীরের চেয়ে মনে হচ্ছিল বেশি। আমার ছোট মেয়েটা তখন বুকের দুধ খায়।একদিনে মা ছাড়া। মা এক ঘরে। বাচচারা অন্য ঘরে। শাশুড়ী এলেন।বাচ্চাদের দেখা শোনা তাদের দাদী আর বাবা করতো। কিন্তু মা তো মা’ই। বুকটা খালি হয়ে গেল মনে হচ্ছিল।আমার ছেলেটাও ছোট বেলায় আমার বুকের উপর ঘুমাতো।মেয়েটাও তাই। মার জন্য তাদের কষ্ট। আমার বুকে কেউ ছুড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল।বাচ্চাদের কাছে পেতে মনটা ছটফট করতো।মেয়েটার জন্য কষ্ট হতো বেশি। বেশি ছোট মানুষ। ছেলেটা একা একা থাকে।একটু পরপরই এসে চিৎকার করে মা মা বলে।দরজার লক করে রাখি।ছেলে বুঝতে চায় না।ডুকে পড়তে চায়।
আমার খাবার ঔষধ যা লাগে মাসুম মানে আমার জামাই দিয়ে যায়।আর কেউ আসে না এ ঘরে। কেমন একটা কষ্টের অনুভূতি। বুঝতে পারছি না।
মেয়েটা তার বাবাকে বাথরুমেও যেতে দেয় না।চিৎকার করে কাঁদে। ভয় ডুকে গেছে মনে।মার মতো বাবাও যদি দূরে চলে যায়। এক মূহুর্তের জন্য তার বাবাকে ছাড়ে না।সেও ক্লান্ত হয়ে যায়।এত কাজ একা করেনি।এত সেবা সে ঐ ১৮/২০ দিন করেছে। তা বলার বাহিরে।তার সেবার জন্য হসপিটালের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি।বাড়িতে সুস্থ হয়েছিলাম আলহামদুলিল্লাহ।
বাচ্চাদের কান্না সহ্য হচ্ছিল না।অন্য দিকে আমার মা পাগল প্রায়। শুধু কাঁদে আর কল দিয়ে বলে,মা তোমার কিছু হবে না।আমি নামাজ পড়ছি। কোরআন শরিফ পড়ছি।রোজা রাখছি।তুমি সুস্থ হবেই।তোমার বাবা অনেক চিন্তা করছে।দোয়া করছে।বোনটাও চিন্তায় শেষ। আমার এত ছোট দুটো বাচ্চা। আমার কিছু হলে ওদের কি হবে? আমারও চোখের পানি যেন এই কথা ভেবে থামতে চায় না।
জ্বর কিছুতেই ভালো হচ্ছিল না।পরে ইবনে সিনাতে গেলাম।ডক্টর টেস্ট দিল।এক্সরে করলাম।নিউমোনিয়া ধরা পড়লো। ডক্টর বলল।চিন্তার কিছু নেই। ঔষধে ভালো হবে ইনশাআল্লাহ। ভয় কাটে না।আরও বাড়লো। তখন করোনার দ্বিতীয় ধাপ ছিল নিউমোনিয়া। শুধু ভয় হতো। এই বুঝি শ্বাস কষ্ট শুরু হবে।কি সেই দিন গুলো যে পাড় করেছি।আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।একদিকে বাচ্চাদের দূরে রাখা। অন্য দিকে নিজের শরীর। এর মধ্যে বান্ধবীরা অনেক ভালোবাসা আর দোয়া করেছে।ওরা হাসিয়েছে। ওরা সাহস দিয়েছে। আমার খুব কাছের তিন বান্ধবী। ছোট বোনটা বাবা মার কারণে আমার বাসায় এলো।বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে।নিজের কথা না ভেবে আমার কথা ভেবে।
বোনটার জন্য বাচ্চারা একটু স্বস্তি পেল।ওকে ছাড়া কিছু বুঝে না।ঐদিকে বোন জব করে।তাতে ঘরে বসেই অফিসের কাজ করতে হচ্ছিল। বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে সেহেরি পর্যন্ত কাজ করত।ওর কষ্টও কম না।যথেষ্ট করছে। একটা বোন থাকা কম ভাগ্যের না এতসব কাজ করে মাসুম হাঁপিয়ে উঠতো। কখনো মেজাজ দেখলে কষ্ট লাগল।মনে হতো, এগারো বছরে কয়বার এমন বিছানায় পড়েছি?তার অসুখে কবে ক্লান্ত হয়েছি? বাচ্চাদের অসুখ হলে একাই সামলাই।নানা কথা মনে হতো।আর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তো। মানসিক চাপের মধ্যে যাচ্ছিল দিনগুলো। আর মৃত্যুর ভয় তাড়া করছিল রাতদিন।
সুখের দিন কেন যেন খুব সংক্ষিপ্ত হয়।এত তাড়াতাড়ি সব এলোমেলো হবে বুঝতে পারিনি।অবশেষে সুস্থ হলাম। নিজের ঘর পরিষ্কার করলাম।নিজে গোসল করে। যখন ঘর থেকে বের হয়ে বাচ্চাদের কাছে গেলাম। মনে হচ্ছিল ওদের বুকের ভিতরে চেপে রাখি।ওদের বুকে নিয়ে সেদিন আবার নতুন করে মা হওয়ার অনুভূতি পেয়েছিলাম।অসুস্থ শরীর যতটা না কাবু করেছে। তারচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে মনের ভয়ানক কল্পনাগুলো।কিভাবে রেখে যাবো এত ছোট বাচ্চাদের? আর আমার বাবা।সে-তো আমাকে মেয়ে না ছেলের মতো মানুষ করেছে। ছেলে না থাকায় কখনো আক্ষেপ ছিল না তার।আমার মনে হয় আমার ছোট বোনের চেয়ে আমাকে বেশি ভালোবাসে বাবা।কি হতো আমার মার? কি হতো আমার বোনটার? ওরা সবাই কষ্টে শেষ হয়ে যেতো। আর যার সাথে এগারো বছর কাটালাম।সেও কষ্ট পেত।জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দ প্রকাশ করার মতো ভাষা নেই। আর সেই যন্ত্রণা ভুলে যাওয়া অসম্ভব। কোণঠাসা হয়ে পড়ে ছিলাম জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে। রাতদিন একা এক কোণে। মহান আল্লাহকে শুকরিয়া। এ জীবন ভিক্ষা দেওয়ার জন্য। আর আপনজনদের দোয়ায় এই ফিরে আসা।
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles