অদৃশ্য বিচার

209439218 181827327252279 4911417704317032737 n1
Read Time:9 Minute, 37 Second
আমাদের সমাজে কিছু নিয়ম চলে আসছে বহুযুগ ধরে। নিয়মগুলো আসলেই ঠিক কিনা তার যাচাই-বাছাই করার কারো সময় নেই। যেমন কারো ডিভোর্স হলো।দোষ ঐ বউয়ের ছিল।আরে মেয়েটা ভালো না।শশুড় বাড়ির মানুষকে সন্মান করতো না।আরে জামাইকে রেখে অন্য কারো সাথে সম্পর্ক ছিল। কেউ বলে,আরে না।রান্না করতো না ঠিক মতো। জামাই কতদিন হোটেলে খাবে।কেউ বলে,বাচ্চা হবে না তাই। আসলে কেউ জানে না। কি ছিল কারণ। তা সে যাই হোক।দোষ তো মেয়েটার।তাই না? কারণ মেয়েটা সমাধান করতে পারেনি।
কেউ জানতেও পারলো না দোষ কার।বা ছেলেটার কি কোন দোষ ছিল।আমরা ছেলেদের দোষ পেলেও বলে দেই,তালি কি এক হাতে বাজে।ঠিকই মেয়েটা খারাপ। বা মেয়েটা কেন পারলো না জামাইকে হাত করতে? সংসার করতে জানে না।মা বাপ কিছু শিখায়নি। ডিভোর্স তো তবুও একটা পথ।কিন্তু যদি জামাই দ্বিতীয় বিয়ে করে।আর বউকে বাধ্য হয়ে ঐ সংসারে থাকতে হয়।তার যন্ত্রণা অসহনীয়। সমস্ত দোষ ঐ মেয়েকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।তার পেটের সন্তানের মতো।
সমাজে কিছু মানুষ আছে। যারা অন্যের কষ্ট উপলব্ধি করতে না পারলেও তার ক্ষততে মরিচ ডলতে জানে।তাদের আসলে মানুষ ভাবতেও ঘৃণা হয়।যাদের ভিতরে মনুষ্যত্ব নেই। তারা মানুষ হয় কি করে?
সেদিন এক পরিচিত ভাবিকে দেখলাম অন্য এক মহিলার সাথে কথা বলতে।তো সে মহিলা চলে যাওয়ার পর ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলাম।বাচ্চাদের নিয়ে নিচে নামলে তার সাথে দেখা হয়।কথা হয়।মুখটা কেমন যেন মলিন। চোখ দুটো ছলছল করছে।হয়তো লজ্জায় পানিটা ফেলতে পারছে না। বললাম, ঠিক আছেন ভাবি? কোন সমস্যা? উনি প্রথমে কিছু বলতে না পারলেও পরে চাপ কষ্ট আর দমাতে পারলেন না।চোখের পানি ছেড়েই দিলেন।
বলতে লাগলেন,ভাবি কিছু দিন আগে রানির বাবা আর একটা বিয়ে করেছে। রনি ভাবির ছেলের নাম।কিছুই জানতে পারিনি। সেদিন এই ভাবি এসে বলল,তাদের মোটরবাইকে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে দেখেছে।রনির বাবাকে খুব জোরাজুরি করার পর সব বলল।আমার বাসায় জানানোর পর সবাই কথা বলেছে।বিচার হলো।তাতে কি বলেন।সব শেষে তাল গাছ পুরুষের।সব দোষ আমার।কত দোষ ভাবি।যা কিনা কোনদিন এর আগে শুনিনি।আমার দোষ ছিল। আমাকে বলত।আমি শুধরে নিতাম।আজ আমার দুই বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবো।সংসার করেছি ১৪ বছর। আমার জমা পুঁজি যা আছে। সব এই সংসার।উনি কথা বলতে পারছিলেন না কষ্টে। কথা আটকে যাচ্ছিল।মনে হচ্ছিল কতদিন মন খুলে কাঁদতে পারেন না।মোটামুটি জোর করে আমার বাসায় নিয়ে আসলাম।বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললো।
আবার বলতে লাগলেন, স্বামী সংসার বাচ্চাদের ছাড়া আর কিছু চিন্তা করিনি কখনো।পড়ালেখা করে একটা জব করলাম না।আজ নিজের পায়ের নিচে মাটি থাকলে।আত্নসন্মান নিয়ে বাঁচতে পারতাম।এখন বাচ্চাদের রেখে মরতেও পারিনি।আর কাঁদতেও পারিনা।ওদের সামনে কাঁদলে ভায় পায়।বাবার তেমন কিছু নেই। তাই সেখানেও যেতে পারি না।সবশেষে এখানেই থাকতে হবে।তিলতিল করে মৃত্যুর সাথে লড়তে হবে।বাচ্চারা বাবা ছাড়া কিছু বুঝে না।এত ছোট ওদের কি বুঝাবো? রনির বাবা বলে, তার সন্তান। সে কখনো ছাড়বে না।আমাকেও ছাড়বে না।বিশ্বাস হয় না।যে এভাবে ধোঁকা দেয়।সে সব পারবে।কি করবো ভাবি? জীবনে কি করলাম? কেন নিজেকে নিয়ে একবারও ভাবলাম না? কেন অন্ধ বিশ্বাস করে আজ অন্ধকারে নিমজ্জিত আমি? আসলেই তো সব দোষ আমার। এত বোকা কেন আমি? কথাগুলো বলে,এমনভাবে কাঁদতে লাগলো। আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম।কি বলবো। কি সান্ত্বনা দিব? তার মাথায় হাত রেখে বললাম,ভাবি আল্লাহ সব দেখেছে।আপনার জন্য ভালো কিছু আমি নিশ্চয়ই। নামাজ পড়েন।আর আল্লাহকে ডাকেন।আর কি বলব,বুঝতে পারছিলাম না।ভাবছিলাম একটা নারী মা হলে তাকে কতটা পাথর হতে হয়।নিজের কষ্ট কমাতে কাঁদার অধিকারও তার নেই।
ভাবি বলল, নিচের ঐ ভাবি যখনি দেখা হয়।এসব জিজ্ঞেস করে। আমার খুব কষ্ট লাগে। আর লজ্জাও লাগে। কিন্তু কিছু বলতে পারি না।বলতে চাই, এসব আর আমাকে বলবেন না।আমার বারবার মনে করতে কষ্ট হয়।দমবন্ধ হয়ে আসে ভাবি।পারি না।কেন সমাজের মানুষ ভাবে ভাত কাপড়ই সব? আমি একটা মানুষ। এটা ভুলেই গেছে সবাই। সবাই বলে নিজের কথা ভেবে কি হবে? বাচ্চাদের কথা ভাবো।ওদের জন্য বাঁচো। ওরাই সব তোমার। কিন্তু আমার তো বাঁচতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মৃত্যুর চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে। শাশুড়ী সব দোষ আমার দেয়।রনির বাবা সব দোষ আমার কাঁধে দিয়ে মুক্ত। আমিও এখন নিজেকেই দোষ দেই।যে মেয়ে শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারে।সে এমনি শাস্তি পাবে।কেন কিছু করিনি নিজের জন্য? বাচ্চাদের ভবিষ্যতে কি হবে? আমার কিছু হয়ে গেলে তাদের কে দেখবে? হাজারো প্রশ্ন মাথায় ঘুরে। তারপর সমাজের মানুষের কত কথা।আত্নীয় স্বজনরা এখনো জানে না।কিভাবে মুখ দেখাবো? মরে যেতে মন চায় ভাবি।কিন্তু বাচ্চাদের জন্য পারি না।আমি তার কষ্ট পরিমাপ করতে পারিনি।তার জন্য কিছু করতেও পারিনি।শুধু বলতে পেরেছিলাম, ভাবি আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন।বাঁচতে হবে।বাচ্চাদের জন্য। আর ভাবতে হবে কিভাবে নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে হবে।সামনে বহু পথ বাকি।যা একাই যেতে হবে।
ভাবি বারবার বলছিল, আমি বিশ্বাস করতে পারি না।এই মানুষটা আমার সাথে এমন করতে পারে।এত সাজানো গুছানো সংসার জীবন। সব এলোমেলো হয়ে গেছে। নিজের হাতে সাজানো সংসার ছেড়ে যেতে পারলাম না।মানুষটা হয়তো আমাকে ভালোবাসেনি।আমি তো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো তাকেই দিয়েছি।তার সাথে কাটানে সময়গুলো আজও মনে করে কাঁদি।দিনরাত এভাবে ঠকাতে তার একবারও আমার বা বাচ্চাদের কথা তার মনে পড়েনি? কত বাজে অভিযোগ করে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলো।আর আমার শাশুড়ী যাকে মার চেয়ে বেশি আপন ভেবে এত বছর তার জন্য করলাম।সে কত আজেবাজে কথা আমার শশুড় বাড়িতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সবাইকে বলেছে।আমার মায়ের জন্য যা করিনি তা শাশুড়ির জন্য করেছি। শাশুড়ী মা হতে না পরলে বউ কি করে মেয়ে হবে? আমি আজও বিশ্বাস করতে পারি না। মানুষটা এমন করতে পারে। মানসিক ভাবে উনি এত ভেঙ্গে পড়েছে।আর কিছু হয়তো ভাবতে পারছিল না।হয়তো তার জায়গায় আমি হলেও পারতাম না।ঝড় এসে সব তছনছ করে দিলো।যার কল্পনাও হয়তো ভাবি করেনি।
সেদিনের পর আমি ভাবির ভালো বন্ধু হতে চেষ্টা করেছি।সমাজে আমরা চাইলেই পারি কারো কষ্ট ভাগ করে নিতে।কারো দুঃখ না বড়িয়ে।একটু আশ্বাস দিয়ে মনটাকে শক্ত করতে।কেন অমানুষিক নির্যাতন করি কটু কথা বলে।অদৃশ্য বিচার করি।আর তার কষ্টের পরিমাপ বাড়িয়ে দেই। এর পরিণাম আরও খারাপ হতে পারে।তা আমারও জানি।
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles