ভাগাভাগি

210656087 483374929425737 5416577902832005031 n
Read Time:11 Minute, 32 Second
(একজনের সত্য জীবন কাহিনী)
রেবা এখন আর নিজেকে মানুষ হিসেবে কোথাও খুঁজে পায় না।সে শুধু এখন সকল অনিষ্টের মূল। নিজের জীবনের এমন করুন পরিনতির জন্য নিজেকে দায়ী ভাবলেও যতটা না কষ্ট হয়।রবি যখন ওকে সকল দোষের কারণ হিসেবে দোষারোপ করে। রেবা কিছুতেই মানতে পারে না।কি করেনি সে রবির জন্য? এক কাপড়ে রবির হাত ধরে চলে এসেছে বাবা মাকে ছেড়ে। এখন অবশ্য তার জন্য অনুতপ্ত হয়।রেবা ভাবে এভাবে বাবা মাকে কষ্ট দেওয়ার ফলই হয়তো আজ পাচ্ছে।
৭ বছরের সংসার। একটা ছেলে সহ সুন্দর জীবন। হঠাৎ সব বদলে যেতে লাগলো। রবির ব্যবসার উন্নতি হচ্ছে। আর ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। বন্ধু বাড়ছে সব জায়গায়। আর ঘরের প্রতি টান কমছে।রেবা আর ছোট ছেলে রকির জন্য তার সময় নেই বললেই চলে। রেবা ভাবে ব্যবসা বড় হচ্ছে। তাই সময় বেশি দিতে হয় কাজে।কিন্তু সময় তো রবি ইচ্ছে করে বের করতে পারে।কেমন যেন দিন দিন রবি বদলে যাচ্ছে। আগের মতো কেন কিছু শেয়ার করে না রেবার কাছে। কোথায় যেন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। রবি এখন একটুতেই রেগে যায়।
রেবা হঠাৎ যেদিন রবির সাথে তার অফিসের এমপ্লয়ি ইতির সাথে সম্পর্কের কথা জানতে পারে ।মাথার উপরে আকাশ ভেঙে পড়ে। মাটি যেন সরে যাচ্ছিল পায়ের নিচে থেকে। রেবা এতটাই বিশ্বাস রবিকে করতো যে কোনদিন রবিকে সন্দেহ করেনি।হাজার মেয়ে সামনে পড়ে থাকলেও তার রবি এমন কিছুই করতে পারে না।তবু যা হওয়ার হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে শুধু ছেলের জন্য রবিকে ফিরাতে চেয়েছিলে রেবা।সমাজ তো কার দোষ তা দেখবে না।বাবা ছাড়া ছেলেটাকে কি করে মানুষ করবে? হাজার প্রশ্নের ভীড় করে মনে। পারিবারিক কারণেও মানতে হয় রেবাকে।
রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যায় রেবা।কিন্তু এত বছরের সংসার আর ছেলের কথা ভেবে শাশুড়ীর কথায় ফিরে আসে। এত বছরের সংসারে আনাচে কানাচে রেবার ছোঁয়া।এত সুন্দর করে গড়া সংসার।রেবা ভাবে রবি তার ভুল বুঝতে পেরেছে।কিন্তু ভুল ধারণা ছিল রেবার।রবি তো হারিয়ে গেছে। রেবা তারা মন থেকে আবার রবিকে ঘর মুখি করতে চেষ্টা করে। আর একটা মেয়ে হয় তাদের। নাম মিলি।ফুটফুটে মেয়েটা ঘর আলো করে রাখার মতো। মেয়ে বলে কথা। মায়া দিয়ে আটকে রাখতে চায় সবাইকে। হঠাৎ রেবা জানতে পারে ইতির সাথে এখনো রবির সম্পর্ক আছে। ঝোড়ো হাওয়ায় সব শেষ করে দিল।
রেবা রবিকে জিজ্ঞেস করতে রবি স্বীকার করে সবকিছু। কি বলবে? আর কি করবে রেবা?সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে মনে হয়।দুটো বাচ্চা নিয়ে কেথায় যাবে? ভালো রেজাল্ট করার পরও ছেলের জন্য চাকরি করেনি।বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়া সম্ভব না।অসুস্থ মা সেখানে।বাবা এই বয়সে কত ভার নিবে?অবিবাহিত ছোট বোন আছে।সে বাবার বাড়ি যেয়ে উঠলে বোনটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে।লোকে বলবে বড় বোন সংসার করতে পারনি।ছোট বোন কি পারবে? আর ছেলেদের দোষ কি আমাদের সমাজে আছে?
যে শশুর বাড়ির মানুষদের জন্য এত করল তারা তো রেবার কাঁধে সব দোষ দিল।রেবা নাকি রবির খেয়াল রাখে না।অথচ এই সংসারের জন্য নিজের কথা কোনদিন ভাবলো না রেবা। সবার জন্য করেছে।শশুর, শাশুড়ী, দেবরদের জন্য তো কম করেনি। অথচ আজ তাকে দায়িত্বহীন বলে দোষ দেওয়া হলো।এভাবেই চলতে লাগলো দিন রাত।রেবা আর ঠিক থাকতে পারছিল না।রেবা যখন বাচ্চাদের নিয়ে চলে যেতে চাইলো।রবি রেবার হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলো।সব ঠিক করে দিবে বলে আশ্বাস দিল।এমনকি ইতিকে ডেকে বলল,এখানেই শেষ। আর কিছু নেই তাদের মাঝে। রবির আকুতি মিনতি দেখে রেবা রবিকে আর একটা সুযোগ দেয়। কতশত স্বপ্ন আজ ধুলিতে মিলিয়ে গেছে। কত স্মৃতি শুধু কাঁদিয়ে যাচ্ছে।
এখানে কতগুলো জীবন জড়িয়ে আছে। একবারও কি রবি আসলেই ভেবেছে তার ছোট দুটো বাচ্চার কথা? যে রেবা তারজন্য এতগুলো বছর করলো। তার কথা কি এত সহজে ভুলে গেল?হঠাৎ রবি রেবাকে জানায় সে ইতিকে বিয়ে করেছে। চোখের অশ্রু দুকূল ছাপিয়ে পড়েছে সেদিন। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল রেবা।বিশ্বাস করতে পারছিল না কথা গুলো। মনে হচ্ছিল রবি পরীক্ষা নিচ্ছে রেবার।কিন্তু এটাই সত্যি ছিল। কার কাছে ছুটে যাবে রেবা? কাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে? পরিবারের সকলের কথা শুনে রেবাকে রবির সাথেই সংসার করতে হয়।মেনে নিতে হয় অমানবিক জীবন। রবি আর তার পরিবার এটাই বুঝতে চায় সবকিছু তো পাচ্ছো।তোমার কি সমস্যা?
মেয়েদের জীবন কি ভাত কাপড়ের মূল্য দিতে দিতেই চলে যাবে? রেবা যাকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসলো সে কিভাবে এত বড় ধোকা দিল? নিজের উপর ভিষণ রাগ দুঃখ ক্ষোভ নিয়ে চুপ করে থাকে রেবা। রবি তাকে বলেছে তার পায়ের নিচে মাটি নেই। কাজেই রবির ইচ্ছে মতো যেন রেবা চলে।রেবার বাবার সামর্থ নেই। তাই রেবার এখানেই মরতে হবে।সব যন্ত্রণা রেবা শুধু তার কলিজা দুটোর জন্য সহ্য করে চলছে। বাবা ছাড়া বাচ্চা দুটো কিছু বুঝে না।কি বলে তাদের বুঝাবে রেবা?
সমস্ত জীবন যেন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল।রবি এখানে এক রাত।সেখানে এক রাত করে কাটায়।রেবা তবুও মেনে নেয়।আসলে না মেনে উপায় নেই। মানতে সে বাধ্য হয়।রাতে যখন বাচ্চারা বাবাকে খুঁজে। রেবার চোখ ছলছল করে। নানা অজুহাত আর কারণ দেখায় ছোট্ট দুটো মনকে।কি করার আছে তার? বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেলে অশ্রুর অতল সাগরে ভেসে যায় রেবা।এই রবি তাকে ছেড়ে একরাতও কোথাও থাকতো না।রেবা কথনো রবিকে রেখে একা বেড়াতো না।আজ কতদূরে তাদের বসবাস। এখন আর রবিকে আগের মতো মনে হয় না।মনে হয় তাদের জন্য যা আছে সেটা শুধু দায়িত্ব। সমাজের জন্য বা বাচ্চাদের জন্য। এটা ভাবতেও কষ্টে বুকটা কেঁদে উঠে।দমবন্ধ হয়ে আসে মাঝে মাঝে। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারে না।কারণ তার কান্নায় বাচ্চা দুটো ভয় পেয়ে যায়।এই ভাগাভাগি যেন রেবার আত্মার।এই ভাগাভাগি যেন রেবার সমস্ত সুখের।রেবার সন্তানদের পিতৃ স্নেহের।রেবার প্রতিটি রাত কাটে অঝোরে অশ্রু ঝরিয়ে।
সন্তানদের মনে যাতে কোন ক্ষত সৃষ্টি না হয়।তারজন্য রেবা রবিকে অনেক কিছুই বলে না।কিন্তু সবকিছু ছেড়ে দিতেও ভয় পায়।সেদিন কিছু কথা বলতেই রবি ভাতের থালাটা ফেলে দিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়।ছোট বাচ্চা দুটোর সামনে রেবা আর নিজেকে সামলাতে পারেনি।অঝোরে কেঁদে ফেলে।ছেলে মেয়ে দুটো ছুটে আসে।বাবা মাকে বলে,তোমারা ঝগড়া করো না। থামো তোমরা। এই ঝগড়া করো না।ছোট মেয়েটা মায়ের চোখের পানি মুছে দেয়।বলে,বাবা দুষ্টু।তুমি কেঁদো না।রেবা সমস্ত ঘর জুড়ে পরে থাকা খাবার আর কাঁচের টুকরো গুলো পরিষ্কার করে।চোখের পানি পড়তে থাকে। কি জীবন কি হয়ে গেল।ছোট মেয়েটা তখনও মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে মাকে শান্তনা দিচ্ছে। মা হয়ে এটা যে কত বড় লজ্জা।
বাবা মায়ের এমন আচরণ সন্তানের মনে কত বড় কষ্টের আঘাত করে। এটা তখন বুঝতে না পারলেও বড় হলে বোঝা যায়। রেবা জানে না এর শেষ কোথায়। একা হলে অনেক আগেই সব ছেড়ে চলে যেতো।আজ বাচ্চাদের জন্য সব আত্নসম্মান লজ্জা মাটি চাপা দিয়ে বেঁচে আছে। বেঁচে যে তাকে থাকতেই হবে। এত কষ্ট করে যাদের পৃথিবীতে আনল।তাদেরকে একা ফেলে সে তো পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারে না।রেবা কতবার ভেবেছে চলে যাবে এ পৃথিবী ছেড়ে। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর পারে না।মা চলে গেলে যে ওরাও আর টিকে থাকবে না।মনকে শক্ত করে রেবা।তবুও বারবার ভেঙে পড়ে।
তাকে বাঁচতে হবে।যুদ্ধ করতে হবে নিয়তির সাথে। সমাজের সাথে। এই ভাগাভাগি জীবনের ভার বয়ে যেতে হবে। এর শেষ জানা নেই রেবার।শত বাঁধা উপেক্ষা করে রেবা বাঁচতে চায়।তার দুটো সন্তানদের জন্য। যারা তার জন্য এই পৃথিবীতে এসেছে। এ যুদ্ধ থামবে না কোনদিন। রেবা জানে না।সে শেষ অবধি ঠিকে থাকবে কিনা।হয়তো একজন মা বলেই এতটা শক্তি আজও আছে মনে। যদি পায়ের নিচের মাটি কোনদিন শক্ত হয়।সে রবির চোখে চোখ রেখে বলবে,আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসে ছিলাম।তা বিশ্বাস করেছি বারবার। আমার অসহায়ত্ব আমাকে ধরে রাখেনি।রেখেছে একটুকরো মায়া।
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles