আত্মসম্মান ঃ প্রথম পর্ব

IMG 20210731 023522
Read Time:9 Minute, 55 Second

অনু বাসা থেকে বের হয়ে চলে এলো। সাথে কিছুই নেয়নি। শুধু তার সাথে বইগুলো। আর তার পড়নের কাপড়টিও ঈদে তার বাবার দেওয়া। ইচ্ছে করেই এই পোশাকে বের হয়ে এসেছে। মনে সীমাহীন কষ্ট নিয়ে চলে এলো।যে মানুষটাকে সারাজীবন ভালোবাসবে বলে এই বাসায় এসেছিল।সেই মানুষকে আজ সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে। নিজের হাতে গড়া সংসার আজ তার কাছে অসহ্য লাগছে।
অনু আর শাহীনের বিয়ে হয়েছে দুই বছর হয়। তখন অনু অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। অনু পড়ালেখা শেষ না করে বিয়ে করবে না। কিন্তু অনুর বাবা ভালো পাত্র পেয়েছে বলে একরকম জোর করেই অনুর বিয়েটা দেয়। অনু বড় তার ছোট এক ভাই আছে। সে এবার এইচএসসি দিবে। তাছাড়া শাহীন বিয়ের আগে কথা দিয়েছে অনুকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াবে।
কিন্তু বিয়ের পর শুরু হয় সমস্যা। অনুর শাশুড়ি কিছুতেই চায় না অনু পড়ালেখা করুক। তারপরও অনু নিজের চেষ্টায় অনার্স ফাইনাল দেয়। সমস্ত সংসারের কাজ শেষ করে তবেই পড়ার সময় পায় অনু। তবুও তার রেজাল্ট ভালো হয়। দিনেরাতে যখনই সময় পেয়েছে পড়েছে অনু। সমাজকল্যাণে ফার্স্ট ক্লাস নম্বর পাওয়া তো কম না। অনু আরও সাহস পায় মনে।কিন্তু শাহীনের তেমন কোন আগ্রহ নেই অনুর পড়ালেখা নিয়ে। সে বরং চায় অনু আর না পড়ুক।এত পড়ে কি হবে?
অনুর শাশুড়ি সবসময়ই বলে
— ঘরের বউ বেশি শিক্ষিত হলে সমস্যা। মাতব্বরি বেশি করে। স্বামীকে মূল্য দেয় না। বেশি বুঝতে চায়।আরও অনেক কিছু।
এজন্য যেদিন অনুর বাবা অনুর অনার্সের রেজাল্ট শুনে মিষ্টি আনলো।সেদিন অনুর বাবাকে একগাদা কথা শুনিয়ে দিয়েছেন অনুর শাশুড়ি। এত পড়ালেখা করে কি হবে? কত টাকার চাকরি পাবে তার মেয়ে? এত টাকা খরচ হচ্ছে তার ছেলের।বাপের বাড়ি থেকে টাকা দেয় নাকি পড়ালেখার? অনুর বাবা সেদিন অনেক কষ্ট পেলেও কিছু বলেনি। শুধু শাহীনকে বলেছিল
— তুমি কথা দিয়েছিলে অনুকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াবে। তুমি না পারলে আমি পড়াব আমার মেয়েকে। তার কাছে দোষী হয়ে থাকব না চিরকাল। কি করবে আমাকে জানিয়ে দিও।
শাহীন চুপ করে ছিল। কোন জবাব দেয়নি সেদিন।
অনুর বাবা চলে যাওয়ার পর অনু তার শাশুড়িকে কিছু না বলে শাহীনকে বলে
— যদি কথা রাখতে পারবে না, তো কেন কথা দিয়েছিলে? আমি মাস্টার্স পড়ব।আর আমার দায়িত্ব এখন তোমার। আমার কোন খরচ এখন বাবার কাছে থেকে নিব না। তুমি না পারলে আমি নিজেই ব্যবস্থা করে নিতে পারব। আমার দায়িত্ব বাবা এত বছর পালন করেছে। এখন আমার উচিত বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করা। সেখানে আমি তাদের বোঝা হব না।শাহীন অনুকে বলে সে তার কথা রাখবে। অনুকে মাস্টার্স পড়াবে।
অনু ঠিকই মাস্টার্সে ভর্তি হয়।কিন্তু ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় অনুর শাশুড়ি নানান কথা শোনায়। মেয়ে মানুষ এত ছেড়ে দিলে পড়ার নামে কই না কই যায়। বাসায় বসে পড়লেই তো হয়। প্রতিদিনই কি যেতে হয়? কত বন্ধু না জানি আছে অনুর।অনুর মন যাতে নষ্ট হয়, আর পড়ালেখা যাতে বাদ দেয় তারজন্য এসব বলে। শাহীন শুনেও না শোনার ভান করে। মায়ের কথা তার কানেই যায় না।তার বউয়ের নামে এত বাজে বাজে কথা তার খারাপ লাগে না কেন? অনু প্রায়ই এই প্রশ্ন করে শাহীনকে। সে বলে
— মায়ের কথায় কান দিও না।মুরুব্বি মানুষ তাকে কি বলবো?
অনু এসব কথা কোনদিন কারো কাছে শোনেনি। এসব কথা তাকে খুব কষ্ট দেয়।বেশি কষ্ট দেয় শাহীনের চুপ করে থাকা।যেখানে অনু শাহীনের সাথে তার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য পড়ালেখা শেষ করে কিছু করতে চায়। সেখানে শাহীন শুধু খরচ দিয়েই শেষ। মানসিক কোন সহযোগিতা অনু পায় না।

আজ অনু বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে অন্য কারণে। সামনে টেস্ট পরীক্ষা অনুর। হঠাৎ জ্বরের জন্য কিছু দিন ভার্সিটিতে যেতে পারেনি। অনু তার বন্ধু লায়লা আর শিহাবকে বলে নোট গুলো অনুর বাসায় দিয়ে যেতে। অনুর শরীর এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি।
কিন্তু অনুর বন্ধুরা নোট দিতে এলে অনুর শাশুড়ি নানান কথা শোনায়।একটা বিবাহিত মেয়ের সাথে একটা ছেলের বন্ধুত্ব হয় কি করে? এসব কি ধরনের ছেলেমেয়ে? পড়ালেখা করতে আসে নাকি অন্য কিছু করে বেড়ায়? অনু লজ্জায় ওদের সামনেই কেঁদে ফেলে।ওরা কিছু না বলেই চলে যায়। অনু শাহীনকে জানালে শাহীন মায়ের দোষ না ধরে। অনুকে দোষারোপ করে। অনু কেন একটা ছেলেকে বাসায় আসতে বলে? একটা ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করার কোন কারণ নেই। এতএত মেয়ে থাকতে ছেলে বন্ধু কেন লাগে? অনু আর কিছু বলার মতো খুঁজে পায় না। তার প্রচন্ড ঘৃণা হয় শাহীনের উপর। অনু তার বইগুলো একটা ব্যাগে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে চলে আসে।
রাগে দুঃখে অনু কোন রিকশা বা সিএনজি না নিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে আসে। হঠাৎ রাস্তায় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। রাগে দুঃখে তার কান্না পায়। জীবন নিয়ে কি আশা ছিল আর আজ কি হলো তার সাথে? বাবাকে এত করে বলার পরেও বাবা তার কথা শোনেননি। আর এই তার এত ভালো ছেলে! এত ভালো পরিবার! শাহীনের বাবা বছর তিন হয় মারা গেছেন। এক ভাই এক বোন শাহীনেরা। বোন বিয়ে করে স্বামীর সাথে লন্ডনে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ কথা হয়। শাহীন মায়ের মনে কষ্ট না দিলেও মাকে অনেক কিছু বুঝাতে পারত।কিন্তু সে কখনো তা করেনি।

অনু এবার একটা রিকশা নিয়ে বাবার বাসায় যায়। অনুকে একা এভাবে দেখে সবাই বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে। এর মধ্যেই শাহীনের কল আসে অনুর বাবার কাছে। অনু তার বাবার মোবাইলটা নিয়ে শাহীনকে বলে
— আজ থেকে আর কোনদিন আমার সাথে যোগাযোগ করবে না। যে স্বামী তার বউকে বিশ্বাস করে না। বউয়ের মানসম্মানের যার কাছে কোন মূল্য নেই। তার সাথে আমি সংসার করবো না। তোমার সাথে আমার সংসার এখানেই শেষ। আমার সাধ মিটে গেছে তোমার সাথে সংসার করার।আর কল করবে না।এই বলে মোবাইল রেখে তার ঘরে চলে যায়।
দরজা লাগিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে অনু। অনু সারাজীবন তার মা’কে দেখেছে শুধু খেটে গেছে। কিন্তু তার কাজের মূল্য পায়নি।মা ছোট থেকে বলতেন যাই কর নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করবে।পড়ালেখা শেষ করবে। নিজেকে কঠিন হতে হবে। মেয়েদের জীবন এত সহজ নয়। মায়ের কথা গুলো মনে আছে অনুর।এতদিন এত কিছু সহ্য করেছে। ভেঙে পড়েনি একমাত্র মা সাহস দেয় বলে।কিন্তু আজ আর টিকে থাকতে পারেনি অনু। তার আত্মসম্মানে লেগেছে প্রতিটি কথা।
অনুকে তার বাবা রাতে এসে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে সেখানে? অনু শুধু এতটুকুই বলে
— আমি আর সেখানে যাবো না বাবা।যেখানে আমার কোন সম্মান নেই। আমি মাস্টার্স শেষ করে চাকরি করবো। নিজের মতো থাকবো।তোমার সমস্যা হলে আমি চলে যাবো। আমার জন্য যেন তোমাদের কোন সমস্যা না হয়।
অনুর বাবা অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
— তোমার কোথাও যেতে হবে না মা।এটা তোমার বাসা। যেখানে আমার মেয়ের আত্মসম্মান নাই সেখানে আমার মেয়ে যাবে না।

চলবে,,,,,

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles