আত্মসম্মান ঃ দ্বিতীয় পর্ব

image editor output image926037403 1627798705941
Read Time:11 Minute, 36 Second

অনুর মনের অবস্থা আর কেউ না বুঝতে পারলেও অনুর মা ঠিক বুঝতে পারছেন। তার মেয়েকে সে খুব ভালো করেই চিনেন। মাঝ রাতে অনু বারান্দায় বসে একা-একা কি যেন ভাবছে। দুই কাপ চা নিয়ে মা পাশে চেয়ার টেনে বসলো।অনুকে চা দিয়ে বলল
— জানি তোমার মন আজ অনেক খারাপ। অনেক কষ্ট লেগেছে। যাকে নিয়ে সুন্দর জীবনের আশায় এতকিছু করছো তার কাছে থেকে কোন সহযোগী পাওনি। আজও শাহীন মায়ের পক্ষ নিয়ে তোমার দোষ দিয়েছে।
অনু অবাক হয়ে বলে
— তুমি এসব কি করে জানলে? আমি তো তোমাদের কিছুই বলিনি।
অনুর মা একটু হেসে বলে
— তোমার ফুফু কল করেছিল। তাকে শাহীনের মা কল দিয়েছিল। তোমার আর শাহীনের বিয়ের ঘটকালি যখন সে করেছে। তখন তোমার কথা তো তোমার শাশুড়ি তাকেই বলবে।
অনু জানে তার শাশুড়ি কি বলতে পারে ফুফুকে।আর ফুফু তো অনুর দোষই দিবেন। জগতে সব দোষ তো মেয়েদের হয়। শশুর বাড়ির মানুষের কোন দোষ থাকে না।তারা তো নিষ্পাপ হয়ে থাকে।
অনু মা’কে বলে
— ফুফু নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে সব আমার দোষ?
অনুর মা বলে
— একদম না।সে শাহীনের মা’কে বলেছে আমার মেয়েকে আপনার বাড়ির বউ করে পাঠিয়েছি। তার বিয়ের সময় আমার ভাই স্পষ্ট করে বলেছিল অনুর পড়ালেখা যেন বন্ধ না হয়। আমি দায়িত্ব নিয়ে বিয়ে দিয়েছি। কারণ আপনি আমার শশুর বাড়ির আত্নীয়। কিন্তু বিয়ের পর থেকে অনুকে এত কিছু সহ্য করতে হচ্ছে আমি জানতাম না। অনুর মা বা অনু কখনো আমাকে এসব বলেনি। আজ আপনার কাছে থেকে শুনলাম।তা না হলে কিছুই জানতাম না। আমার ভাইয়ের একটাই মেয়ে। মেয়ে এত ভারি হয়নি যে এত অপমান সহ্য করে আপনার ছেলের সাথে সংসার করতে হবে অনুর। আমাদের মেয়েকে মেয়ের মতো রাখার কথা বলে এখন ছেলের বউয়ের মর্যাদাও দিচ্ছেন না। মেয়ে আর পাঠাবো না যদি যোগ্য শাশুড়ি আর স্বামী না হন আপনারা মা ছেলে। অনেক বউ পাবেন ছেলের জন্য। কিন্তু অনুর মতো বউ পাবেন না।
এসব কথা শুনে তোমার শাশুড়ি বোবা হয়ে গিয়েছিলেন নাকি। এগুলো তোমার ফুফু নিজে কল করে বলেছে আমাকে। আরও বলেছে শাহীন আর ওর মা যদি তাদের ভুল বুঝতে না পারে তো মেয়ে এখানেই থাকবে। সারাজীবন এসব অপমান আর মানসিক অত্যাচার সহ্য করা যাবে না। আজ বাবা মা আছে অনুর।কাল একা হলে কে দেখবে ওকে? অনু এখানেই মাস্টার্স শেষ করবে।তারপর দেখা যাবে। আমাদের মা খালারা এসব সহ্য করেছে কারণ তাদের কোন গতি ছিল না।নিজের পায়ের নিচে মাটি ছিল না। আমাদের মেয়েরা এগুলো সহ্য করে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচুক তা আমি চাই না।

ফুফুর কথা শুনে অনুর চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। এই ফুফু ছোট বেলা থেকে কত বকেছে। কিছু করতে গেলেই বলেছে মেয়ে মানুষ এটা করা যাবে না,ওটা করা যাবে না। কত বাঁধা নিষেধ দিয়েছে। আজ অনুর পক্ষ নিয়ে এতগুলো কথা বলে অনুকে সাহস দিল আর শক্ত বানালো ফুফু

অনুর মা অনুর মাথায় হাত দিয়ে বলেন
— মেয়েদের জন্য জীবন অনেক কঠিন রে মা। মেয়েরা শিক্ষিত হলেও আজও তাদের অতীতের মতো করেই চালাতে চায় সমাজ আর পরিবার। নিজেকে শক্ত হতে হবে।হেরে গেলে তো হবে না।নিজের জন্য জীবন নামের ময়দানে থেকেই লড়তে হবে। তোমার শাশুড়ি তোমার সাথে তাই করছে যা তার সাথে করা হয়েছে। সে এটা ভাবছে না যে,তুমি তার একমাত্র ছেলের বউ। তার সাথে যা হয়েছে তা যেন তোমার সাথে না হয়। এই জ্ঞান কোনদিন মায়েদের হবে কিনা জানি না মা। তোমাকে নিজের জায়গা করে নিতে হবে।তোমার শাশুড়ি তার জায়গা হারানোর ভয়ে তোমাকে শাহীনের কাছে থেকে দূরে রাখছে। এতটা পথ এসেছো বাকি পথও যেতে হবে।

অনু মায়ের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে
— তুমি কি আমাকে ফিরে যেতে বলছো মা?
মা হেসে বলে ফিরে তুমি গেলেও নিজেকে মজবুত করে যাবে। সম্মানের সাথে যাবে। শাহীন তার ভুল স্বীকার করে নিয়ে যাবে তোমাকে। তোমার আত্মসম্মান নষ্ট করে তোমাকে সেখানে পাঠাবো না।
যতদিন তারা তাদের ভুল না বুঝতে পারবে তুমি এখানে থেকেই তোমার পড়ালেখা করবে। তোমার রাস্তা তোমাকেই গড়তে হবে।বিয়ে একবার হয়ে গেছে। আর তার জীবন কেমন হয় তাও তুমি জানো। নিজেকে এমন ভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে কেউ তোমাকে ভাঙতে না পারে। না শাহীন, না শাহীনের মা।একমন কি ভবিষ্যতে তোমার সন্তানেরাও যেন তোমাকে সাহসী ও মজবুত মানুষ হিসেবে জানে। আজ নিজের জন্য লড়াই করছো।কাল তোমার মেয়েকে গড়তে হবে ঠিক এভাবেই।

তুমি তোমার নিজের চিন্তা করো।তোমার কাজ চালিয়ে যাও। শাহীন কি করে আমরা দেখবো। তুমি তোমার মতো করে তো কম চেষ্টা করনি এই দুই বছর। সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কেউ এত বাজে কথা কিভাবে বলে?তুমি ঘুমিয়ে যাও।কাল থেকে ভার্সিটিতে যাবে। স্বাভাবিক জীবন শুরু করো।দশজন দশ কথা বলবে, কান দিবে না।
অনু মায়ের হাত ধরে বলল
— মা তোমার জন্য আজও এতটা শক্ত হয়ে আছি।আমার আদর্শ তুমি। প্রতিটা পদেপদে শিখিয়েছো কিভাবে চলতে হয়।

অনু নিয়মিত ভার্সিটিতে যাচ্ছে। এরমাঝে কয়েকবার কল করেছে শাহীন অনুকে।কিন্তু অনু কথা বলেনি। শাহীনের মা হয়তো রাগে বা লজ্জায় অনুর বাসায় যোগাযোগ করেনি। তিন মাস হয়ে গেছে অনু স্বামী সংসার ছেড়ে বাবার বাসায়। হঠাৎ একদিন অনুর বাবার কাছে শাহীনের বড় বোন কল করে অনুর সাথে কথা বলতে চায়। অনু তার মায়ের জন্য বাধ্য হয়ে কথা বলে। কারণ অনুর মা চাচ্ছিল অনুর সাথে তার কথা হোক।

শাহীনের বোন অনুকে বলে
— তুমি এতদিন বাসা ছেড়ে এখানে এসেছো আমি জেনেও তোমাকে কিছু বলিনি। কারণ মা যা করেছে, অন্যায় করেছে। তার এসব বলা ঠিক হয়নি।আমি চাচ্ছিলাম মা বা শাহীন যাবে তোমাকে আনতে।তুমি তো শাহীনের সাথে কথা বলো না।ও আমাকে বলেছে তোমাকে ওভাবে বলা তার ঠিক হয়নি। তাছাড়া মা কষ্ট পাবে ভেবে মা’কে কিছু বলে না শাহীন। তোমার সংসারে তোমার ফিরে যাওয়া উচিত অনু। তোমাকে ওখানে থেকেই নিজের জায়গা করতে হবে। সব মেয়েদের জীবন এমনি। তবে তুমি অবশ্যই নিজেকে শক্ত ও সাহসী করে তুলবে।পড়ালেখা শেষ করে নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে। যাতে কেউ তোমাকে অসহায় না ভাবে।
অনু শাহীনের বোনের কথায় খুশি হলেও তার কষ্ট দূর হয় না। রাগ অভিমান নিয়ে বলে
— আপু এই দুুই বছর আমি সংসার আর পড়ালেখা সব নিজের চেষ্টায় করেছি।শাহীনের কাছে থেকে টাকা ছাড়া আর কোন সহোযোগিতা আমি পাইনি।আম্মা আমার পরীক্ষা শুরু হলেই তার নানান অসুখ বিসুখের কথা বলেন। আমার উপর সব চাপ ফেলে উনি আমাকে কষ্ট দেন। কখনো ভাবেন না,আমার পরীক্ষা চলছে।আমাকে একটু হলেও সাহায্য করা উচিত ওনার।এমন কি শাহীনও ভেবে দেখে না। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় পড়ালেখা করছি আপু।তাদের জন্য এতকিছু করি।তারা কি আমার জন্য এতটুকু করতে পারে না? তারপর আম্মার এত বাজে বাজে কথা আমি মেনে নিতে পারবো না। শাহীন বাসায় আসলেই আম্মা আমার নামে নানান কথা বানিয়ে বানিয়ে বলে। শাহীন আমার উপর রেগে যায়। কেন একজন মা তার ছেলে আর বউয়ের শান্তি সহ্য করতে পারে না? আমি এখানেই ভালো আছি।মাস্টার্স শেষ করে একটা চাকরি খুঁজে নিব।এতটা অসম্মানের জীবন আমি চাই না।তারচেয়ে একাই থাকবো সারাজীবন আপু।

শাহীনের বোন আর কিছু বলল না।ভালো থেকো বলে কল রেখে দেয়। অনু ভাবতে থাকে যে মানুষটার সাথে সারাজীবন কাটাবো সে যদি আমাকে নাই বুঝতে পারে। তার সাথে থেকে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে একা থাকাই ভালো।এতে যত কষ্টই হোক একটা আত্মতৃপ্তি আছে। শাহীন তার মা’কে খারাপ কিছু বলুক তা অনুও চায় না।কিন্তু সে তার মা’কে অনুকে এসব অপমান করা আর বাজে কথা বলা বন্ধ করতে তো বলতেই পারতো। সেটাও সে কোনদিনই করেনি।এসব ভাবতে ভাবতে অনু আবারও কাঁদতে লাগল। শাহীন কখনোই অনুকে বুঝতে চায় না।অনুর ভালো-লাগা মন্দ লাগা শাহীনের কাছে কোন ব্যাপারই না। অনু আরও বেশি আবেগ প্রবণ হয়ে যায় এই ভেবে যে শাহীন কি কখনো তাকে ভালোবাসতে পেরেছে? নাকি শুধুই একটা বন্ধনে আবদ্ধ তারা? অনুর আজ সত্যি মন খারাপের দিন। অনেক কষ্ট হচ্ছে তার।কোন হিসাবই যেন আজ মিলে না?

চলবে,,,,

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %

Average Rating

5 Star
0%
4 Star
0%
3 Star
0%
2 Star
0%
1 Star
0%

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Social profiles