অনু নিজের মধ্যে কষ্ট পুষে রাখতে শুরু করলো। কাউকে কিছু বুঝতে দিতে চাচ্ছিল না। নিজের মনের কাছে প্রশ্ন করে যাচ্ছে কোথায় তার দোষ ছিল? কোথায় তার ভালোবাসার কমতি ছিল? সবকিছু ছেড়ে গিয়ে কেন তাদেরকে আপন করতে পারলো না? কেন তারা অনুকে এতটা পর মনে করে? কেন তাকে তার শাশুড়ি সহ্য করতে পারে না?
এসব চিন্তা কিন্তু অনুর অযৌক্তিক নয়।কারণ সব আত্মীয়স্বজনেরা এর মধ্যেই জেনে গেছে অনু বাবার বাসায় এতদিন ধরে আছে। অনেকেই কল করে জানতে চায় কি হয়েছে? অনেকেই বুদ্ধি দেয় কি করতে হবে। অনেকে মজা নেয়। আবার কেউ কেউ আগুনে ঘি ঢালে, পুলিশ কেস করে সায়েস্তা করতে বলে শাহীনের পরিবারকে।কিন্তু অনু এসবের কিছুই চায় না। সে চায় তার সম্মান। ঐ পরিবারে তার ভালোবাসা চাই। কিন্তু তা আদোও সম্ভব কিনা তা অনু জানে না।
সামনে অনুর ফাইনাল পরীক্ষা। সব চিন্তা একদিকে রেখে পড়তে চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউ না কেউ নিভানো আগুন জ্বলাতে আসেই। আজ মামা মামী এসেছে অনুর বিষয়টা ভালো করে জানতে।তাদের কথা শুনে মনে হলো অনুকে বিয়ে দিয়ে সবার সব দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে। অনুর বাবার বাসায় এখন অনুর কোন অধিকার নেই। অনু মেহমান হয়ে আসতে পারে। তবুও শাহীনের সাথে। একা এখানে অনুর থাকা মানে বাবার সম্মান নষ্ট করা। অনুর মামা বেশ কড়া করে বলল
— দেখো অনু, তোমার বিয়ে হয়েছে। তুমি সবকিছুই বুঝতে পারো।অবুঝ তো না। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে নানা ধরনের কথা উঠেছে। তুমি এই বংশের নাম খারাপ করছো।এসব কোন মেয়ে করেনি।শশুর বাড়িতে অনেক কিছু হয়। কিন্তু কেউ এভাবে চলে আসে না তোমার মা’কে দেখে তো তোমার শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল।
অনু এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল।এবার তার ছোট বেলা থেকে জমানো অভিমান আর রাগ বের হয়ে আসলো।অনু তার মামাকে বলল
— মায়ের কাছে থেকেই তো শিখেছি মামা।মনে আছে আপনার? আমার দাদা আমার মা’কে নানা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কারণ মায়ের ছেলে হয়নি। তখন নানা অনেক কিছু দিয়ে আবার মাকে এ বাড়িতে দিয়ে যায়। যতদিন মায়ের ছেলে হয়নি মা’কে নানা ধরনের অত্যাচার করে দাদা দাদী।মা কিন্তু আর বাবার বাড়ি যায়নি,রাগে আর অভিমানে। কারণ মা এই কষ্ট কোনদিনই ভুলতে পারেনি। মা নানার কাছে এতটাই বোঝা হয়েছিল। যে নানা তাকে আবারও এত যন্ত্রণা ও অপমান সহ্য করার জন্য রেখে যায়। কারণ মা অনেক অনুরোধ করেছিল নানাকে আবারও পড়ালেখা শুরু করবে নানার বাসায় থেকে। আর ফিরবে না যতদিন না দাদা দাদী মা’কে সম্মানের সাথে নিয়ে না যায়। কিন্তু নানা সমাজ আর তোমাদের কথা শুনে মা’কে রেখে যায়। এসব কথা আমি মায়ের কাছেই শুনেছি।
ছেলে হওয়ার পর মায়ের আদর বেড়ে গেলেও মা কখনোই আমার আর মায়ের সাথে করা অন্যায় ভুলতে পারে নাই। বাবা তখন শাহীনের মতোই নিরব দর্শক ছিলেন। দাদা দাদী মৃত্যুর পর বাবা মায়ের সম্পর্কের উন্নতি হয়।বাবা এখন অন্য এক মানুষ। আজ নিজের মেয়ের জন্য সবার সাথে লড়তে জানে। আমাকে অপমানিত হতে দিতে চায় না বাবা। আমি মায়ের মতো ধুঁকে ধুঁকে মরতে চাই না।সংসার যদি করি আত্মসম্মানের সাথেই করবো মামা।আমি তাদের জন্য কি করিনি? আমি সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি।তারা আমার সাথে কি করেছে?
মামা মামী দুজনেই অনুকে বোঝাতে চেষ্টা করে এসব সব,ঘরেই হয়। এগুলো মেনে নিয়েই চলতে হয়। আমরা, তোর বাবা,চাচাদের সাথে করে নিয়ে গিয়ে কথা বলি।মেয়েদের এত রাগ জেদ ভালো না মা। তুই তোর শাশুড়ি আর শাহীনের কাছে ক্ষমা চাইলে তারা সব ভুলে যাবে।তোকে মেনে নিবে।
এবার অনুর গায়ে আগুন ধরে গেল।অনু রাগে বলল
— প্রশ্নই উঠে না। আমি কোন অপরাধ করিনি। আমার বন্ধুরা আমাকে নোট পৌঁছে দিয়ে সাহায্য করতে এসেছিল। আমার চরিত্র এত খারাপ হলে তাদের তো আমাকে মেনে নেওয়ার কথা না।শাহীন অফিসে যায়।সেখানে কত মেয়েরা আছে তার সাথে কাজ করে। এমন কি তাদের সাথে অফিস পার্টি ও পিকনিকেও যায়।তাদের সাথে ছবি তুলে। কই আমি তো কোনদিন সন্দেহ করি নাই। বাজে কথা বলি নাই। তাছাড়া অফিসের কোন অনুষ্ঠানে বউ সহ যেতে বললে শুধু আমার শাশুড়ির জন্য আমাকে সাথে নেয় না শাহীন। এগুলো কি কারো চোখে পড়ে না? আমি কি শাহীনের যোগ্য নই? স্বামী করলে দোষ হয়না।আর বউ কিছু না করলেও তাকে চরিত্রহীন বলা যাবে।এই অপবাদ আমি মেনে নিব না মামা। তোমরাা বেশি চাপ দিলে আমি বাসা ছেড়ে চলে যাবো। তখন কিন্তু তোমাদের সম্মান আরও বেশি নষ্ট হবে।
অনুর বাবা অনুকে বলল তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। আর তোমার মায়ের সাথে যা হয়েছে তা তোমার সাথেও হতে দিব এমন নয়। যা হয়ে আসছে তাই হবে চিরকাল এমন তো না। তুমি তোমার ঘরে যাও।সামনে পরীক্ষা তার প্রস্তুতি নেও। এগুলো আমি দেখবো।
অনু তার ঘরে চলে গেল।নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে কাঁদতে লাগল। আর ভাবতে লাগল এখনো কিছুই বদলায়নি। সমাজ আগের মতোই আছে। পরিবার কিছু করতে চাইলেও সমাজ আর আত্মীয়স্বজন পাহাড় হয়ে সামনে দাঁড়ায়, বংশ আর সম্মানের দোহাই দিয়ে। বাবা মা’কে দুর্বল করে দেয় নানান ভয় দেখিয়ে।
অনুর ছোট ভাই হোস্টেল থেকে চলে এসেছিল শাহীনকে একহাত দেখে নিবে।এত বড় সাহস।তারই বড় বোনকে চরিত্রহীন বলে! বেটার হাড্ডি সব ভেঙে দিবে।অনু তাকে অনেক বুঝিয়ে আবারও হোস্টেলে পাঠায়।যদিও বলে গেছে কিছু হলে একটা কল দিবে। আমি ওকে শিক্ষা দিব।এটা বোনের জন্য ভাইয়ের ভালোবাসা। অনু আজ দূর্বল ভাবে না নিজেকে।কারণ তার বাবা,মা আর ভাই তার সাথে।
অনুর হঠাৎ করে তার বান্ধবী তমার কথা মনে হয়। শশুর বাড়িতে স্বামী, শশুর, শাশুড়ীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দুই বাচ্চা রেখে আত্মহত্যা করেছিল। অনু এখনো তমার কথা ভেবে কাঁদে। প্রাইমারি থেকে কলেজ পর্যন্ত এক সাথে পড়েছে দুইজন। এইচএসসির পর তমার বাবা বিয়ে দিয়ে দেয়। বাবার কাছে এত আকুতি মিনতি করেও পড়ালেখার জন্য বিয়েটা বন্ধ করতে পারেনি। অসহ্য মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে করতে নিজেকেই শেষ করে দিল।অনু তমার এমন খবর শুনে অসুস্থ হয়ে যায়। তমাকে শেষবার দেখতে পারেনি। অনু তমার জীবন চায় না।তমার মৃত্যুর পর এক বান্ধবীর কাছে শুনেছিল তমাকে ওরা মেরে হয়তো আত্মহত্যা বলেছে। তমা অনেক শক্ত মেয়ে ছিল। অনু মেনে নিতে পারেনি তমার চলে যাওয়া। তমার মৃত্যুর পর ওর স্বামী বাচ্চাদের তমার মা’কে দিয়ে আসে। হয়তো নামে মাত্র কিছু খরচ দেয়। হয়তো এখন আর দেয় না। আজ তমা তমা বলে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে অনুর। অনু জানে না তমার বাবা মা এখন কোথায় থাকে। একবার শুনেছিল ওনারা গ্রামে চলে গেছে।
চারদিন পর অনুর ফাইনাল পরীক্ষা। অনু আজ প্রবেশপত্র আনতে ভার্সিটিতে গেছে। বাসায় ফিরবে এমন সময় ভার্সিটির গেটে শাহীনকে দেখতে পায়।
চলবে,,,,,